ষাটের ক্রান্তিলগ্নে কবিকূল যখন বিরাগবাসী কিংবা হতাশার পাণ্ডুরোগে বেদনাহত, অথবা অন্ধকারের বৃহন্নলার মতো অশ্লীল-খেউড়ে মত্ত, আসাদ চৌধুরী তখন সমাজ ও জীবনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিষণ্ন এক লড়াইয়ে নেমেছেন। জীবন নামক এক মোহন পাখিকে স্থাপত্যে শিল্পের মর্যাদা দিতে গিয়ে তিনি তখন ব্যতিব্যস্ত। অস্ত্র হিসেবে তাঁর হাতে তখন লৌকিক দর্শনের সুক্তি। সেই দার্শনিক অস্ত্র দিয়ে তিনি চিরে চিরে দেখেছেন ব্যক্তি, সমাজ, স্বদেশ, ক্রান্তিকাল এবং ব্যক্তি-অন্বেষা। সেখানে ছায়া ফেলেছে সমাজ, মানুষ ও জীবন, কখনো তা বিপ্রতীপ, কখনো সরাসরি, ব্যঙ্গে, বিদ্রূপে, বক্রোক্তিতে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যখন বিপন্ন, ষাটের আইয়ুবী শাসনামলের সামরিক দাপট যখন বাংলা-সংস্কৃতির শিকড় টেনে ফেলে দিয়েছে মাটিতে; আগাছা আবর্জনার গরল ছিটিয়ে বাংলার দিগন্ত যখন করেছে কলুষিত, অনুর্বর, নারীর মতো বিষণ্নতা, ক্লেদ এবং মনোকষ্ট আকছাড় ছড়াচ্ছে চারিদিকে ব্যথার পদাবলী, আসদ চৌধুরী তখন হয়ে উঠেছেন উচ্চকণ্ঠ, প্রত্যক্ষ; কখনো বা আড়াল-আবডাল। কিন্তু সর্বদাই সমাজমনস্কতা তাঁকে উচ্চকিত ও উদ্দীপিত করেছে সমালোচকের সাহসে, অস্ত্রে, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে এবং প্রতিবাদে সচেতন ভাস্কর্যে। সংবেদনশীলতা জীবনমুখিন, যা তাঁকে প্রত্যয়ী-আবেগে দৃঢ়তা দিয়েছে। তাঁর এই মনোভঙ্গির আদলে কাব্যভুবনের শরীরী চিত্রকলা নির্মাণ করা সম্ভব :
মনোভঙ্গি : উচ্চকণ্ঠ ও প্রত্যয়
প্রকাশভঙ্গি : স্পষ্টতা, সারল্য ও ঋজু।
————————————
আবেগ +প্রত্যয় ও দৃঢ়চেতনাদায়বদ্ধতা : সামাজিক
অবলম্বন : লোকায়ত ভাবনা ও লৌকিক দার্শনিক সুক্তি, সমাজ- সমালোচনা ও ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ: প্রতিরোধীচেতনা।কিংবা কোথাও বা, সমাজ-সচেতনামূলকতায় এসেছে করুণঘন আর্তি/ হৃদয়ানুভবতা : সংবেদনশীল।
লৌকিক বিষয়ভাবনা, লৌকিক ছন্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে আসাদ চৌধুরী তাঁর সমাজচেতনা সচেতনমানসতার স্বরূপ নিদর্শন করেছেন। ক্রান্তিকালের স্বদেশের বুকের বন্ধ্যা জলাশয়ের এই নিস্তরঙ্গ নিরালম্ব সময়কে তিনি লৌকিক তীর ধনুকের ছিলায় বিদ্ধ করেছেন, এ যেন তাঁর চক্রব্যূহে একা একলব্যের ক্রসফায়ার। মুসলীম লীগের তল্পিবাহক, পুঁজিবাদী শাসক সামরিক শাসনের ছড়ি ঘুরিয়ে যখন সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় ঔপনিবেশিক ও জাতীয় শোষণে পরিব্যপ্ত এবং জাতিহত্যার নামে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিধনে দাঙ্গাবাজের মতো কসাই, তখন সেই ঐতিহ্য রক্ষায় একক সৈনিকের মতো আসাদ চৌধুরী লড়ছেন সময়ের সঙ্গে, সমাজের জন্য, মানুষকে ভালোবাসার নির্দয় এষণায়। জীবন, সমাজ এবং সময়ের প্রতি তাঁর আনুগত্য বিধৃত যুদ্ধোত্তর একক কবি-বিভঙ্গে চিত্রার্পিত দৃশ্যে: ‘আমি চিরকাল অনুগত / সমাজের, সময়ের, স্বাভাবের, অভ্যাসের/ আজ্ঞাবহ, ক্রীতদাস আমি/ ব্যথা ও রেওয়াজের বাইরে গেলে/ দারুণ অস্বস্তি লাগে।’ কবির এই উচ্চারণে আত্মধিক্কার-এর পাশাপাশি আত্মস্বীকৃতিও শিরোধার্য হয়েছে। সমাজমনস্কতাই তাঁর এই আত্মদর্শনের ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রতিবিম্ব।
মহত্তর জীবনের উৎক্রান্তি তাই আসাদ চৌধুরীর কবিতা ধারণ করে আছে। তাঁর দর্শনে বর্গীর ছায়াপাত। ধান, পান পশ্চিমা শোষকশ্রেণির ঘরে চলে গেলে তবক কোথায় দেবে মানুষ? ‘দুধ মাখা ভাত কাক’ নামক শ্রেণিশত্রু লুটেপুটে খাবে এবং শোষিতশ্রেণি নিস্পৃহ চুপ হয়ে জাবর কাটবে, তা মূলত নপুংসকতারই পরিবাহক। শোষকশ্রেণিকে তিনি তাই মনোহারিত্ব-এর মায়াজাল ছাড়িয়ে ডেকেছেন শিশুর আন্তরিকতায়, ‘আয়রে মুর্দা ঘরে আয়/ দুধ-মাখা ভাত কাকে খায়।’ ( ধান নিয়ে ধানাই পানাই)। মমত্বের লৌকিক ছন্দে তা বিন্যস্ত।
এভাবে আসাদ চৌধুরী সময়ের ক্লেদের চিত্র নির্মাণ করেন। রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বলেন। ঐতিহ্যসংলগ্নতা ও মগ্নচৈতন্যের ইতিবাচক দুঃসাহসিকতা দিয়ে সাহসের সমাচার শোনান। ষাটে তিনি এভাবে সময়-এর ক্লিবত্ব, ভীতু জনগণের অসহায়তা এবং মধ্যবিত্ত মানসিকতার বিপ্রচেতনার বৃত্তান্ত শুনিয়েছেন। শোষকশ্রেণির নামাবলীর আড়ালের ভণ্ডামির চারিত্র্য নির্দেশ করে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। এই প্রতিবাদ আনত হলেও সদর্থক, দায়বদ্ধ। ব্যঙ্গ- বিদ্রূপহীন সময়ের নিশানার প্রতি সমর্পিত হয়ে কখনো তাকে নির্বিবাদ আনত মনোভঙ্গীর পরিচয় দিতে লক্ষ্য করা গেলেও এবং বিচারের মাপকাঠিতে এককোষী অ্যামিবার মতো মনে হলেও, তা বস্তুত দীর্ঘযাত্রার সমুদ্র-গমন। বিষয় ভাবনার বিন্যাসে, শব্দচয়ন ও ছন্দবদ্ধতায় লোকায়ত ভুবন নির্মিত হলে তাকে খুবই নিরালম্ব ও জীবনের প্রতিবেশী মনে হয়, যেখানে অন্তত নাগরিক ভণ্ডামী অন্তর্হিত। ষাটের দিবানিশি অবক্ষয় ও বিশ্বাসহীন গরল আকণ্ঠ পান করেও তিনি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ।
তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’-তে তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েনের গল্প শোনেন। মধ্যবিত্তের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দোলাচলবৃত্তির ছবি আঁকেন তিনি নিপুণ শিল্পীর মতো। তাঁর কবিতার মধ্যে শ্রেণিসত্তা ও মধ্যবিত্তচেতনালোকের একটা দ্বন্দ্ব আছে, যার সঙ্গে এসেছে আত্মধিক্কার এবং আত্মজিজ্ঞাসা।
তৃতীয় গ্রন্থ ‘প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়’-এ তিনি নির্দেশ করেছেন সমাজের প্রবাহমান দুর্নীতি ও অনাচারের দৃশ্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভাষায়। রাজনৈতিক অনাচারে তিনি দুঃখ পান। মানবতার অবমূল্যায়নে এক্ষেত্রে তিনি তিতিবিরিক্ত : ‘সিংহের থাবার চেয়ে মানুষের হাত/ অনেক বিশাল।’
‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ ও কবির জীবনাদর্শের প্রতিকল্প। কবির পক্ষপাত জীবনের প্রতি, যে জীবন তাঁকে কবিতা লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায়। যেখানেই জীবনের সম্ভাবনা, জীবনের উৎসার, সেখানেই তাঁর উৎপাদনের সঞ্চার: ‘যে ডোবায় জল বিনীত হ’য়ে তৃষ্ণা মেটায়,/ সংসারের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে, / বুকে ধরে রাখে টাকা কিংবা উজানো কই তার প্রতিই আমার পক্ষপাতিত্ব। ( আমার পক্ষঘাত)। এই পক্ষপাতিত্বের গুণেহ কবির ‘শব্দ হচ্ছে সত্যের কঠোর হাতিয়ার। মিথ্যার মোহন মায়াজালা, কূটনীতি সত্যের কাফন।‘এবং এরই মধ্যে কবিকে বেছে নিতে হয় প্রিয় শব্দাবলী, যা তাঁর অমোঘ অস্ত্র।
‘যে পারে পারুক’, কাব্যগ্রন্থে বৃত্ত অতিক্রমের একটা দ্রোহী- মনোভঙ্গির গন্ধ মিললেও তা দ্বন্দ্বমুখর। শিল্পীসত্তা ও ব্যক্তির শ্রেণিসত্তার এখানে অনিবার্য সংঘাত। এই কাব্যে যুদ্ধেত্তোর বাংলাদেশের বিপন্ন সময়ের একটা অসহায় সুরও পরিলক্ষিত হয়। পলায়নপর মনোবৃত্তের একটি ঈঙ্গিতও লক্ষ্য করা যায় কিছু কবিতার বিষয়ভাবনায়। তবে ‘রিপোর্ট ১৯৭১’, ‘এ কেমন জন্মদিন’, ‘আমার শত্রু নাই’, ‘আনো রিফু করে’, ‘বারবারা বিডলার’- কে ইত্যাদি কবিতায় প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও সমাজচেতনা স্পষ্টতা পেয়েছে। ‘তবক দেওয়া পান‘থেকে শুরু করে ‘যে পারে পারুক‘পর্যন্ত এই দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় কবি আসাদ চৌধুরী বহু সংঘাত ও দ্বন্দ্ব পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘসময়ের কালগত বলয়ে তাঁর মানসতার বিপরীতমুখীন চারিত্র্য শব্দবিন্যাসে এরকম দাঁড়ায় :
হতাশা< > আশাবাদ : মধ্যবিত্তশ্রেণি < > সর্বহারার বোধ-এই দুই বিপরীতমুখীন চেতনা ও দ্বন্দ্ব, সময়ের প্রগতি-প্রতিক্রিয়া, গ্লানি ও আশাবাদ আসাদ চৌধুরীর সারা জীবনের নিয়তি। এর মধ্য দিয়েই রাজনীতি তীক্ষ্ণ হয়, প্রত্যক্ষ হয়। গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সেই চেতনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব হত্যার চিত্রাভাস এবং পঁচাত্তরের পরবর্তী আর্থ-সামাজিক অবক্ষয় তাঁকে হতাশ ও দ্রোহী করে তোলে। ফলে সংক্ষুব্ধ চেতনায় কাব্যভুবনের বিষয়বস্তু বাংলাদেশ ছাপিয়ে তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তাঁর কাব্যশরীরের এক বিন্দুতে মিলিত হয় তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের আশা -আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম। লোকায়ত দর্শনের পটে নির্মিত আত্ম-জিজ্ঞাসার সূচনা ‘যে পারে পারুক‘কাব্যে উদ্দীপিত হয়ে জ্বলে ওঠে। এভাবেই তিনি সমাজের কাছে তথা সময় ও মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা পালন করেন। তাঁর কবিতার শরীরে বাংলাদেশের বিগত দশকগুলির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দোলাচল বিম্বিত হয়ে আছে।
বিশ্লেষণ : বিষয়বস্তুগত-১ / তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে
মরার চোখে আগুন ছিলো
একথা কে ভাববে?
কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং, কই মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।এখন এ-সব স্বপ্ন কথা
দূরেরশোনা গল্প
তখন সত্যি মানুষ ছিলামএখন আছি অল্প।
ষোলো পঙ্ক্তির এই কবিতাটিতে সময় ধরে রেখেছেন কবি আসাদ চৌধুরী। ষাটের ক্লেদ ও অসহায়ের কথা আছে কবিতাটিতে। আছে ষাট- পূর্ব যুগের স্বপ্নচারিতা। তখন জীবনে তেজ ছিল, জীবনবোধ ছিল, চেতনা ছিল, এবং পরিব্যপ্ত দ্রোহ ছিল। কিন্তু ষাটের আইয়ুবী সামরিক শাসনকালে পদলেহী কুকুর বেড়ালেরা পর্যন্ত হিংস্র হয়ে ওঠে। জীবনের রং হয় ফ্যাকাসে। পূর্বজীবন দূরবর্তী গন্ধ হয়ে ওঠে। নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতে কবি তখন ব্যর্থ। আত্মধিক্কার তাঁর সারাশরীরে, মানসে।
বিষয়টা এরকম। নদীর জল, বৃষ্টি এবং বীরাঙ্গনার উদাসী দৃষ্টিতে পর্যন্ত আগুন ছিল, প্রতিবাদ ছিল। গানে ছিল বিদ্রোহাত্মক সুর, কাব্যে ছিল জ্বালাময়ী ভাষা। এমন কি মৃত্যুর চোখ পর্যন্ত বিদ্রোহাত্মক পরাভয় নিয়ে মারা যেতেন। অথচ ষাটের প্রথমার্ধে ( আইয়ুব খান শাসনে বসেন ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে) সামরিক শাসন জারি হয়। দেশের জনজীবনে নেমে আসে স্তব্ধতা। বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ধারা কমে যায়। যাদের কোনো গুরুত্ব ছিল না, সেই সব গুরুত্বহীন তল্পিবাহক কুকুর বেড়ালের মতো থাবা হাঁকায়। এমনকি সামান্য শিং, কৈ মাছেরা পর্যন্ত মুখিয়ে ওঠে। এই যন্ত্রণার কবি ক্লিষ্ট। তখনকার মনুষ্যজীবন ষাটের গল্পের মতো শোনায়। ষাটের আগুনহীন, প্রতিবাদহীন, বিদ্রোহহীন এক সময়ে কবিবে মানুষ বলে চিনতে দৃষ্টিভ্রম হয়। আগে ছিলাম পূর্ণ মানুষ, ষাটে তার সামান্যই বর্তমান। মানুষের পরাভাবে কবি বীতস্পৃহ।
বিশ্লেষণ : অবয়বগত ২। মনুষ্যত্বের মূল্য নেই
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যের ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’ কবিতাটিতে পঙ্ক্তি সংখ্যা ষোলো (১৬)। স্তবক মোট চারটি। কবিতাটিতে অতীতচারিতার স্বপ্ন আছে, রোমান্টিক আতিশয্য আছে বলে বেশীরভাগ শব্দই নরম। পংক্তিগুলো ছোট্ট, মাত্র পাঁচটি ভারি শব্দ তরঙ্গ তোলে। এই ভারি শব্দগুলিও নরম শব্দগুলির অনুষঙ্গ-অনুবর্তী। প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় ও চর্তুথ পংক্তির অন্ত্যমিল আছে। অন্ত্যমিলেও সমান্তরাল ও বৈপরীত্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। শব্দচয়নে তাই সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। ‘আগুন ছিলো বৃষ্টিতে‘এবং ‘উৎস করা দৃষ্টিতে’। দৃষ্টির নির্মোহ উদসতার সঙ্গে বৃষ্টির নির্মাল্যের সমান্তরালতা পরিলক্ষিত। ‘আগুন ছিলো কাব্যে এ কথা কে ভাববে? ‘কাব্যের বোধ ও ভাবনার বোধের মেলবন্ধন আছে। ‘সাপের ফণার সঙ্গে জ্বলে বালির কণার‘সমান্তরালে অর্থদ্যোতনা ঘটেছে। চতুর্থ স্তবকের গল্প- এর সঙ্গে অল্প – মেলবন্ধনের চমৎকারিত্ব আছে। স্তবকের সূচনা থেকে ক্রমশ চতুর্থ স্তবকে এলে একটা ক্লান্তি ও নষ্টালজিয়ার গন্ধ মেলে। ঋজভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটা ক্রমশ নেতিয়ে পড়ে। কোমল শব্দের ব্যবহার এবং গল্পের সঙ্গে ‘এখন আছি অল্প‘ব্যবহার করে একটি ক্লান্ত কণ্ঠস্বরের আভাস দেয়। সেই আওয়াজ যেন দূরাভাষের মতো শোনায় : হতাশাগ্রস্ত, বেদনাহত । ষাটের রাজনৈতিক অবক্ষয়ে বিশ্ব গ্লানি গলাশ এসে ভর করে, যেখানে মনুষ্যত্বের অবমূল্যায়ন হয়।
বিশ্লেষণ : ৩/ তবুও পূর্ণিমা : স্বাধীনতা
‘প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়‘কবিতাটি গ্রন্থনামের শেষ কবিতা- এর সঙ্গে বিষয়গত মিল আছে আল মাহমুদের লোকলোকান্তরের ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন‘কবিতার। আল মাহমুদ বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষের ভাগ্যের স্থবিরতায় দুঃখ পান আসাদ চৌধুরীর মতো। ‘অরণ্যে ক্লান্তির দিন‘কবিতায় তিনি নষ্টালজিয়ার বাতাস ছড়ান : ‘এখানে ঘটে না কিছু, শুধু এক আশার পাষাণ বুকে নিয়ে জেগে থাকা/ পিলসুজে পুড়ে যায় তেল।‘আসাদ চৌধুরীর কবিতায়ও সেই একই অনুরণন। ঢাকাকেন্দ্রিক কবি মধ্যবর্তী সমতল অঞ্চলের মানুষকে দেখেছেন বহুদিন। তাঁদের ‘দুঃখ ও অপমানের ব্যথায়‘কাতর হয়ে কবি গিয়েছিলেন উত্তরের পাহাড়ে। হয়তো বা শান্তি- সন্ধানে। কিন্তু সেখানে তিনি দেখলেন :
‘তখন খরা, পাতায় পাতায় জণ্ডিসের নাচন। ( পঙ্ক্তি : ২)।
এবং ক্ষুদ্রজাতুসত্তার সারল্য নিয়ে সেখানকার মানুষেরা ‘শিয়রে দুঃখ আর নেতা কূপি নিয়ে রাত জেগে ‘কেবলই দুঃস্বপ্ন দেখছে। আর কিসের প্রত্যাশায় যেন ‘পাঠশালা কাম গীর্জায় নিঃসঙ্গ যীশুর কাছে কি কি প্রার্থনা করছে ওরা।‘আল মাহমুদ লিখেছেন : ‘কোন্ গাঁর কার মেয়ে মোম জ্বেলে দরগা তলায় কী যেন প্রার্থনা করে/… অথচ ঘটে না কিছু। ‘কবিতাটির মধ্যে নৈরাশ্য আছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য আছে ভিক্ষুকের হাতে। কিন্তু তার মধ্যেও আশাবাদধ্বনিত : একটি পূর্ণিমার জন্য এখন আমাদের প্রতীক্ষা। এই কাঙ্ক্ষিত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় সত্তরের বাংলাদেশ ভেসে গিয়েছিল স্বাধীনতার লোনা রক্তে।