অজয় এত তাড়াতাড়ি পুনে থেকে কলকাতা বদলি হয়ে আসবে স্বপ্নেও ভাবেনি। একেবারে ডি.এম. পদে পদোন্নতিতে অজয়ের স্ত্রী শকুন্তলার বুক গর্বে ভরে উঠেছে। আসলে লকডাউনের বাজারে অজয় ওয়ার্ক ফ্রম হোমে যে কর্মকুশলতার স্বাক্ষর রেখেছে, তাতেই খুশি হয়ে ম্যানেজমেন্ট তাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছে। হলদিয়ায় কোম্পানির অবস্থা লকডাউনে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল দেখেই অজয়কে তারা যোগ্য বলে বিবেচনা করে এনেছে।
হলদি নদীর একেবারে গায়ে কোম্পানির বাংলো। সুন্দর পরিবেশে ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো বাসস্থান। ঠিক তার পাশেই অফিস। পূর্বাঞ্চলের জোনাল হেড-অফিস। অফিসও বেশ সুন্দর করে সাজানো। চেম্বার থেকে হলদি নদীকে খুব কাছে মনে হয়। যেন জানালায় টাঙানো একটা ছবি।
অজয়ের বাংলোর বারান্দা থেকেও হলদি নদীকে খুব কাছে বলে মনে হয়। রেণু রেণু সূর্যের প্রথম আলো হলদির বুকে যখন পড়ে, তখন হলদিকে সোনায় মোড়া এক উজ্জ্বল অপরূপা কিশোরী মনে হয়।
আষাঢ় মেঘের জাফরিতে আকাশটা যেন মোড়া। ফাঁক-ফোকর দিয়ে ব্রাহ্মমুহূর্তের আলো এসে পড়ছে বারান্দায়। কয়েকটা রাতচরা পাখি ডাকতে ডাকতে চলে যেতেই অজয় বারান্দার ইজি চেয়ারে এসে বসলো।
সপ্তাহের প্রথম লকডাউন। অফিস যাওয়ার খুব একটা তাড়া তাই ছিল না অজয়ের। তবু ল্যান্ডফোনটার রিং-টোনে ঘুম ভেঙে যেতেই সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে চলে এল বারান্দায়।
এক কনট্রাক্চুয়্যাল স্টাফ এত ভোরে ফোন করায় অজয় বেশ ক্ষুব্ধ হলো। মনে মনে ভাবলো শ্রমিকদের সাহসটা এরাজ্যে বেশ বেড়ে গেছে। যখন তখন ছুটি চায়। সরাসরি ঢুকে পড়ে চেম্বারে। ফোন করে বাড়িতেও।
শকুন্তলার আসকারাতে মাত্র কয়েকদিনেই কনট্রাক্চুয়্যাল লেবার, দারোয়ান, পিত্তন – সবাই তার সাথে অনায়াসে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। বাড়ির ল্যান্ডফোন নম্বর নিয়েছে।
ছোট মেয়ে তিতলি ঠিকই বলে – বাপি, যার তার সঙ্গে না মেশাই ভালো। আর লেবার টেবারকে কেন ফোন নম্বর দাও বলতো। বাড়ির কাছেই তো অফিস। দরকারে অফিসে যাবে।
হ্যাঁ নেহাত কোভিড নাইনটিন এসেছে, তাই লকডাউন হওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের গাঁয়ে ফিরে আসার জন্যে তীব্র আকুতি চোখের সামনে উপস্থিত হল। কত রকম কাজই না করতে গেছে বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে।
এগারো বছরের তিতলি যেন বাবার প্রতিলিপি। তিতলিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে অজয় বারান্দা থেকে দেখলো হলদি কেমন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আঁকাবাঁকা শান্ত নদী যেন ঘুম ভেঙে এঁকে বেঁকে চলেছে। অনেকটা গিয়ে মিশেছে হুগলি নদীতে। হুগলি নদীর ঠিক উপর একটু দূরে নয়াচর দ্বীপ জেগে উঠছে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়াচর।
ডোর বেল বাজতেই শকুন্তলা দরজা খুলে আকাশকে বলল, হ্যাঁ সাহেব উঠেছেন। বারান্দায় বসে ল্যাবটবে কাজ করছেন।
-না ম্যাডাম আমি আর ডিসটার্ব করবো না। সাহেবকে। আপনি একটু বলে দেবেন আমি মায়ের সৎকার সেরেই ফিরে আসবো। আমার ছুটিটা যেন মঞ্জুর করে দেন।
-মায়ের সৎকার! চমকে জিজ্ঞাসা করলো শকুন্তলা।
আকাশ বলল, হ্যাঁ, মা কাল রাতে মারা গেছেন। জানি না করোনা কিনা! তবে বেশ ক’দিন ধরে জ্বর ছিল।
অবাক হয়ে শকুন্তলা দেখল সামান্য মাইনের কন্ট্রাক্চুয়্যাল কর্মী আকাশকে। ভোর থেকেই ফোন করে যাচ্ছে একটু সাহেবের অনুমতির জন্যে। অজয় অনুমতি দিলে মা-কে শেষবারের মতো দেখতে পারবে। আকাশের মাতৃভক্তি, অফিসের প্রতি দায়বদ্ধতায় শকুন্তলা মুগ্ধ হয়ে গেলো।
উচিত না হলেও শকুন্তলা বলল, হ্যাঁ যাও আকাশ। আমি সাহেবকে ম্যানেজ করে নেবো।
যাবার আগে আকাশ শকুন্তলার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল, আপনি ঠিক আমার মায়ের মতো।
দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল শকুন্তলা। ঠিক তখনই খবরের কাগজ দেওয়া ছেলেটি বলল, কাগজ নিয়ে যান দিদি। হাত বাড়িয়ে একরত্তি ছেলেটার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতে চমকে উঠল। প্রায় সব কাগজের প্রথম পাতায় ট্রেনে কাটা পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবি ছাপা।
ধীর পায়ে কাগজগুলো নিয়ে শকুন্তলা কাঁপা কাঁপা হাতে অজয়ের হাতে দিল। শকুন্তলাকে দেখে অজয় বলল, কে এসেছিল?
-আকাশ।
-তুমি ওই লেবার ক্লাস লোকদের কেন প্রশ্রয় দাও বুঝতে পারি না।
— সে তুমি বুঝবে না। কারণ তুমি তো বরাত জোরে শাসালো চাকরি পেয়ে গেছ, তাই আজকের দীনদরিদ্রের কষ্ট ঠিক বুঝতে পারো না।
-তুমি বোঝো কী করে?
আমি বুঝি কারণ আমি খুব সাধারণ গরীব ঘরের মেয়ে। বাবা সামান্য প্রাইমারি মাস্টার ছিলেন। বাবাকে দেখেছি বিনাপয়সায় বছরের পর বছর কত ছেলে মেয়েকে টিউশন দিয়েছেন।
কথাগুলো শেষ করেই প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক খবরের কাগজের ছবি দেখিয়ে বলল, দেখ, দেখ কতজন পরিযায়ী শ্রমিক ট্রেনে কাটা পড়ে অকালে চলে গেল। ভাবতো ওদের পরিবারের কী হবে! কে দেখবে, কে চালাবে সংসার।
বিস্ময়ে অজয় তাকিয়ে দেখল খবরের কাগজের ছবির দিকে। মনে মনে যদিও ভাবল, কী নিষ্ঠুর দৃশ্য। মুখে তাই বলল, সত্যি বর্বর এই ঘটনা মানব সভ্যতার লজ্জা। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন ঘটনা এখনও ঘটেনি। শুধু লজ্জা বলো না। দায়হীন একটা সরকার চলছে। মানুষের জন্যে যাদের কোনো দায়িত্ব নেই। শুধু ভাষণ দিচ্ছে। আহা, যেন মানুষের দুঃখে সারাক্ষণ মন কাঁদছে।
শকুন্তলার কথা শেষে হতেই অজয় বলল, এখানকার সরকারই বা কী করছে। কোনো শিল্প কারখানা হচ্ছে না। অথচ লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী প্রতি বছরই পাশ করে বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। কাজের আশায় চলে যাচ্ছে ভিন রাজ্যে। কত লক্ষ যে বাংলার শ্রমিক প্রতিদিন অন্য দেশে, রাজ্যে চলে গেছে —তার কোনো হিসাব নেই।
হ্যাঁ নেহাত কোভিড নাইনটিন এসেছে, তাই লকডাউন হওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের গাঁয়ে ফিরে আসার জন্যে তীব্র আকুতি চোখের সামনে উপস্থিত হল। কত রকম কাজই না করতে গেছে বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে।
শকুন্তলার সেলফোনটা বাজছে শুনে হস্তদন্ত হয়ে ঘরে গিয়ে বলল, হ্যালো। হ্যালো, বল ভাই। এত ভোরে ফোন করলি কেন?
ওপারের কথা শোনা না গেলেও শকুন্তলার কথায় বোঝা গেল তার ভাই সুদিন ফোন করেছে।
ছবির পরিযায়ী মৃত শ্রমিকেরা যেন তার ছোটবেলার সেই ভাঙা পুতুলের মতোই পড়ে রইলো নিচে।
ফোনটা নিয়ে বেশ গম্ভীর মুখে শকুন্তলা আবার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে অজয়কে বলল, জানো – ভাই ফোনে এখুনি জানালো আমাদের দেশের বাড়ির প্রফুল্ল আর তার বৌ-ছেলে কাল রাতে ট্রেনে কাটা পড়েছে। নাসিক থেকে পরিযায়ীদের দলে ফিরছিল গাঁয়ে। ইস্, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত শরীরে একটু বিশ্রাম করার জন্যে রেললাইনে বসেছিল। ঘুম ঘুম চোখে কেউ টের পায়নি যে পিছন থেকে মালগাড়ি ছুটে আসছে। অজয় ম্লান চোখে জিজ্ঞাসা করল, শুনেছিলাম প্রফুল্ল তোমার বাবার প্রিয় ছাত্র ছিল।
হ্যাঁ। অসাধারণ হাতের কাজ জানতো। একবার দেখলেই যেকোনো কাজ চটপট করতে পারতো। মাটি দিয়ে ঠাকুর গড়া, কাগজের ফুল বানানো ছিল জলভাত। তামার পয়সা কেটে কেটে কী অসাধারণ গহনা গড়তো, দেখলেই সবার তাক লেগে যেতো।
শিল্পীর সহজাত প্রতিভা নিয়েই তোমাদের প্রফুল্ল জন্মেছিল। তাই সুদূর বোম্বে শহরে গিয়ে ঠাঁই করে নিতে পেরেছিল অনায়াসে।
শকুন্তলা বললো, বাংলার স্বর্ণবাজারে প্রকৃত কোনো সুযোগ না পেয়েই পাড়ি দিয়েছিল ভিনরাজ্যে। অনায়াসে যেমন অর্থবান হয়েছিল, তেমন নামও হয়েছিল খুব। নদীয়ার দেশ গাঁ থেকে কত বেকার ছেলেমেয়েদের কাজ দিয়ে সে নিয়ে গিয়েছিল নাসিক। তাদের হাতের ছোঁওয়ায় ওখানকার স্বর্ণশিল্প আজ পৃথিবী-বিখ্যাত।
কথাগুলো বলতে বলতে শকুন্তলার চোখের কোণ ভিজে উঠল। আঙুল দিয়ে খবরের কাগজে ছাপা ছবির ভেতর থেকে প্রফুল্লকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। হালভাঙা নাবিকের মতো ব্যর্থ শকুন্তলা এবার ডুকরে কেঁদে বলল, হায়! পোড়া দেশ – পেট যে রাজ্য চেনে না। পেটের তাগিদে ছুটে চলে দেশ-দেশান্তরে। জন্মভিটের দাগ মুছে দেয় বুভুক্ষু পেট।
শকুন্তলা আর নিতে পারছিল না পরিযায়ী শ্রমিকদের এমন করুণ মৃত্যু। শরীরের সব শিরা উপশিরা দিয়ে দেশের ওপর ঘৃণার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কাঁপা তার আঙুল কাগজের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু ছবির পরিযায়ী মৃত শ্রমিকেরা যেন তার ছোটবেলার সেই ভাঙা পুতুলের মতোই পড়ে রইলো নিচে।
শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে অজয় উপলব্ধি করল, পেশাগত উচ্চতার আঁচে মানুষ হিসাবে তার মনন আজ আর বেঁচে নেই।