সার-সংক্ষেপ: ছোটগল্পের ভুবনে আপন আলোয় উদ্ভাসিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর দৃপ্তকণ্ঠের প্রতিবাদী গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’। গল্পটিতে আবহমান বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থান কেমন তা দেখানো হয়েছে। নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে বর্ণিত দুটি বিশেষ চরিত্র মৃণাল ও বিন্দু। একজন প্রতিবাদী। অন্যজন শোষিত-নিপীড়িত। দুই নারীর জীবন দুুদিকে মোড় নিলেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরই গল্পের মূল ভিত্তি। মৃণালের প্রতিবাদী সত্তা তাই হৃদয়ে নতুনভাবে জাগরণ ঘটায়। নারীর মর্যদা বাড়িয়ে তুলতে অদম্য প্রেষণা জোগায়। বর্তমান প্রবন্ধে সেই বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-এর হাতেই উনিশ শতকের শেষ দশকে আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের জন্ম। জমিদারি দেখভালের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঘটে। ফলে রবীন্দ্রগল্পের মূল কেন্দ্রভূমিই হয়ে ওঠে বাংলার গ্রামীণ বিভিন্ন চিত্র-চরিত্র। তাঁর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’। গল্পটি ১৩২১ বঙ্গাব্দে ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ এই গল্প বলার সময় একটু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। পুরো গল্পটিই একটি চিঠির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। গল্পের মূল চরিত্র মৃণাল। তার জবানিতেই গল্পের কাহিনিতে প্রবেশ করে পাঠক। মৃণাল এক অদম্য নারী। তার চরিত্র এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের খুব কম নারী চরিত্রই এতটা প্রতিবাদী, পরিপূর্ণ। গল্পের আদ্যোপান্ত পাঠে উঠে আসে নারীর জীবন, নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, অবহেলা, পুরুষতন্ত্রের রূঢ়তা, শোষণ-শাসনসহ নারীর প্রতিবাদ। গল্প বলার ঢং ও তেজস্বী মেজাজ ‘স্ত্রীর পত্র’কে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, ‘স্ত্রীর পত্র সামাজিক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীর বিদ্রোহ।’১
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় নারীর জীবন সর্বদা সংকটাপন্ন। বাবার বাড়ি হোক বা শ্বশুর বাড়ি; কোথাও সঠিক অবস্থান নারীকে দেওয়া হয় না। গল্পের মুখ্য চরিত্র মৃণাল। তার জীবনটাও কোনোদিন সঠিক গতিতে চলেনি। মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে শিশুকাল থেকেই অনেক কটুকথা হজম করতে হয়েছে। পরিবার সমাজ কটু কথা বলতে দুবার ভাবেনি। মৃণাল মনোবল হারানোর মেয়ে নয়। তাই প্রতিবাদই হয়েছে তার একমাত্র ভাষা। কিন্তু এই মৃণাল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চলতে পারেনি। ছোটবেলায় সান্নিপাতিক জ্বরে ভুগে তার ভাইটি যখন মারা গেলো এবং একই রোগে ভুগে মৃণাল ফিরে এলো, তখন পরিবার-সমাজ সেটাকে বেশ সুবিধার মনে করেনি। বরং অল্পবয়সী মেয়েটির প্রতি চালিয়েছে সামাজিক শোষণ! নারী হয়ে জন্মালে ক্ষয় নেই, তাই সে বেঁচে গেছে। কিন্তু মৃণালকে যারা কটুবাক্যে জর্জরিত করেছে, তাদের অধিকাংশই নারী!
(…) সেই শিশুবয়সেই আমি আর আমার ভাই একসঙ্গেই সান্নিপাতিক জ্বরে পড়ি। আমার ভাইটি মারা গেলো, আমি বেঁচে উঠলুম। পাড়ার সব মেয়েরাই বলতে লাগল, ‘মৃণাল মেয়ে কি না, তাই ও বাঁচল, বেটাছেলে হলে কি আর রক্ষা পেত। চুরিবিদ্যাতে যম যত পাকা, দামি জিনিসের পরেই তার লোভ।’২
নারীর জীবনকে অসম্মানের করে তুলেছে পাড়ার নারীরাই! দুটি বিষয় এখানে বিদ্যমান। প্রথমত, নারীই নারীর শত্রু। দ্বিতীয়ত, পুরুষ দামি, নারী মূল্যহীন। নারীর জীবনকে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন করে তোলে পুরুষ-নারী উভয়ে মিলে। পুরুষতন্ত্র কখনোই নারীকে যোগ্য সম্মান-মর্যাদা দেয়নি। ভবিষ্যতেও পূর্ণ সম্মান দেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
কিন্তু পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একশ্রেণির নারীও নিজেদের ছোট করে। অসম্মান-অশ্রদ্ধা করে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা বোঝেই না, তাদের নিজেদের দমন-পীড়ন কতটা করা হচ্ছে! মৃণাল বেঁচে গিয়ে সমাজের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থায় আজও নারীর জীবনকে মূল্যহীন মনে করা হয়। মৃণালও সেই মূল্যহীনের দলে আর একটু সংযোজন। তাই এই ছোট্ট শিশুর প্রতি চলে মানসিক নিপীড়ন।
ফলে দুজন দুজনের পরম আশ্রয়, মমতা, ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে একে অন্যক আগলে রাখার ব্রত মনে গ্রহণ করে।
কন্যা শিশুবয়সী হোক বা পূর্ণ বয়সী হোক, নারী কখনোই স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে না। পরিবার-সমাজ করতে দেয় না। যেই মৃণাল রোগে ভুগে মরেনি বলে একশ্রেণির আফসোসের শেষ নেই, তারাই মৃণালকে পণ্য হিসেবে পাত্রের সম্মুখীন করেছে। মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে স্বামীর সংসারে পাঠিয়েছে। পাড়াগাঁয়ের এক মেয়েকে শুধু রূপের কারণে বউ বানিয়েছে। নারী যে আবহমানকাল ধরে রূপের কারণে সমাদর পায়, সে নমুনাও গল্পটিতে এসেছে। মৃণালের বড় জায়ের রূপের অভাব থাকায় সেই ঘাটতি পূরণ করতে চেয়েছে মৃণালকে দিয়ে।
মেয়ে সন্তান জন্মানোর পর থেকে বাবা-মায়ের শত চিন্তা থাকে। তারা ভাবেন, মেয়েকে কেমন পাত্রের হাতে তুলে দেবেন! রূপ থাকলে সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের চিন্তার নব্বইভাগ কমে যায়। কিন্তু যদি রূপের ঘাটতি থাকে, তবে তাদের চিন্তার শেষ নেই। এমনকি বাবা-মাকেও কটূকথা শুনতে হয়। কিন্তু রূপ সে তো স্রষ্টার দান তা নিয়ে কেন নারীকে এতটা হেনস্তার শিকার হতে হয়! যুগের পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু এই অমানবিক মানসিকতার সিকিভাগও পরিবর্তন ঘটেনি।
রবীন্দ্রনাথ যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে সে চিত্র এখনো রয়ে গেছে মজ্জায়। বাঙালি জাতি সঠিকতার চর্চা করতে জানে না বিধায় নারীর যোগ্যতা দক্ষতা নয় বরং তার রূপে মুগ্ধ হয়। আজও সমাজে মৃণালের মতো হাজারও মেয়ে বিদ্যমান। বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর রূপ জিনিসটাকে যে কত যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হয় সে সম্পর্কে রবীন্দ্র গল্পে পায়,
শহরের দেবতাকে পাড়াগাঁয়ের পূজারি কী দিয়ে সন্তুষ্ট করবে। মেয়ের রূপের ওপর ভরসা; কিন্তু সেই রূপের গুমর তো মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি দেখতে এসেছে সে তাকে যে দামই দেবে সেই তার দাম। তাই তো হাজার রূপে গুণেও মেয়েমানুষের সংকোচ কিছুতে ঘোচে না। ৩
নারীর প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে তাকে পূর্ণ সম্মান দেওয়া হয় না বরং অনেকটা পশুর মতো আচরণ করা হয় নারীর প্রতি। বাঙালি সমাজে পাত্রস্থ করার জন্য যে সামজিক রীতি-নীতি সেগুলো শুধুই কি নারীকে অসম্মান করার অন্য নাম নয়! নারীকে এ সময় ব্যাপক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। পরীক্ষায় পাস করলে তবেই অন্যের ঘরে বউ হয়ে আসার অনুমতি মেলে। নতুবা তার কপালে জোটে অসম্মান। এই রীতিনীতির ব্যত্যয় ঘটেনি ছোট্ট মৃণালের জীবনেও। তাই শ্বশুর ঘরে এসে নিপীড়ন জোটে ভাগ্যে। যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীকে পণ্য সামগ্রীর মতো ব্যবহার করে চলেছে। আজ অবধি কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। বরং যুগের সঙ্গে নারীকে ব্যবহারে পুরুষতন্ত্র নতুন নতুন ফাঁদ পেতেছে।
নারীর রূপ থাকলেও বুদ্ধি থাকতে নেই। নারীর বুদ্ধিকে পরিবার ও সমাজ সর্বনাশ হিসেবেই গণ্য করে। অনেকে মনে করে, নারীর বুদ্ধি বেশি থাকা মানে সংসারে অশান্তি। মৃণালের বুদ্ধি সাধারণ নারীদের থেকে ভিন্ন ছিল। তাই তো প্রচলিত সমাজের স্রোতধারায় নিজেকে বিলীন করতে পারেনি। বরং পরিবার ও সমাজকে সে ত্যাগ করেছে। মৃণালের বুদ্ধির জোর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির কেউ ভালো চোখে দেখেনি। উল্টো মৃণালের ওপর বেড়েছে অত্যাচার।
নারী হয়ে কেন সববিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে! কিন্তু মৃণাল সামাজিক গণ্ডি ভেদ করে নিজের অপ্রাপ্তিগুলো পুরুষতন্ত্রে¿র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। চাইলেই নারীকে সস্তা করে ফেলা যায় না বরং নারীর ইচ্ছেই প্রধান। তাই বুদ্ধির দোষে মৃণালকে শ্বশুরবাড়িতে তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে। নারীর বুদ্ধিই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গলার কাঁটা। গল্পে পাই, ‘মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম উদবিগ্ন ছিলেন, মেয়ে-মানুষের পক্ষে এ এক বালাই (…) তোমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল দিয়েছ।’৪
নারীর বুদ্ধি থাকা যেমন দোষের, তেমনি তার কোনো সৃজনশীলতাও সমাজ মেনে নেয় না। বর্বর যুগের মতো নারীকে আবদ্ধ রাখতেই আজকের পুরুষতন্ত্র বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নারীর একা চলা, একা শক্ত অবস্থান তৈরি করার পক্ষে থাকে না পরিবার-সমাজ। বরং তাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নারী মানেই বিয়ে-বাচ্চা-সংসার সামলানো।
মৃণালের মধ্যে লুকিয়ে ছিল কবিসত্তা। কিন্তু পরিবারের বেশিরভাগ নারীর পথকে রুদ্ধ করতে চায়। নারীকে তার সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতে দিতে হবে। মৃণাল লুকিয়ে কবিতা লিখলেও তার যোগ্যতা তারই। ভালোবাসায় আগলে রাখলে মৃণালের মনঃকষ্ট দূরীভূত হয়ে স্বামী-সংসারের জন্য সুনাম বয়ে আনতো। কিন্তু মৃণালের প্রতিভা অব্যক্ত এবং আড়ালেই রয়ে গেছে। স্বামী কখনো মনের এই অপ্রকাশিত খবর রাখেনি। মৃণালের মতো বহু নারী সমাজ ও সংসারের চাপে পড়ে নিজের অদম্য মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে না। একসঙ্গে বহুবছর কাটিয়ে দেওয়ার পর একজন আরেকজনের রুচি, ইচ্ছে, মন-মর্জি বোঝার সক্ষমতা রাখে না। এর প্রমাণ মেলে মৃণালের জবানিতে।
আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাঁশ যাই হোক-না, সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি; সেইখানে আমি আমি। আমার মধ্যে যা-কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে, সে তোমরা পছন্দ কর নি, চিনতেও পার নি; আমি যে কবি, সে এই পনেরো বছরেও তোমাদের কাছে ধরা পড়েনি। ৫
বাবা-মায়ের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠার পর একটি সময় মেয়েদের অন্যের ঘরে যেতে হয়। সেই যাওয়া কোনো নারীর পক্ষেই খুব একটা স্বাভাবিক নয়। বরং প্রথম দিকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে না অনেকেই। মৃণালও তার বুদ্ধির সমকক্ষ কাউকে পায়নি। অন্যরাও তার বুদ্ধির দরুণ তাকে এড়িয়ে গেছে। ফলে নতুন পরিবেশে মৃণাল একা অসহায় হয়ে পড়ে। তার সমব্যথী হয় নির্জীব কিছু প্রাণী। তাদের সঙ্গেই মৃণালের আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অচেনা বাড়িতে কয়েকটি পশুর মায়া তাকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেয়। মৃণাল এই অবলা পশুদের মধ্যেই চিরপরিচিত মুখের ছাপ খোঁজে! তার বিশ্বাস জন্মে নারীও ঠিক এই প্রকার নির্জীব অসহায় পুতুল।
আমাদের সমাজে তাই নারীকে যে যেমন খুশি, নাচাতে থাকে। মৃণাল তার সংসারে নিজের অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ সামাজিক সংস্কার-রীতিনীতি। যা প্রথা রূপেই সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বিরাজমান। নারীর জীবনযাপনকে রুদ্ধ করলেও শৃঙ্খল পরিয়ে তাকে করে তোলা হয় পুতুল। মৃণাল (মেজবউ) নতুন সংসারে একের পর এক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। কোনোরকমে পশুর সঙ্গে আত্মীয়তা করলেও পরিবেশের সঙ্গে ভাব জমাতে পারেনি। একে তো পরিবারের চাপ তার ওপর অসুস্থ পরিবেশ মৃণালকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। জন্মের পরই মৃণালের মেয়েটি মারা যায়। বিশ্ব সংসারে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। কিন্তু সেখানেও নারী হিসেবে লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই ভাগ্যে জোটেনি।
জীবন এতটাই তুচ্ছ যে, মৃণালের যে আঁতুড়ঘরে অবস্থান হয়, তা আর্বজনায় ঠাসা। নারীর জীবন তো অবহেলার। সে চিত্র পুরো গল্পে বিদ্যমান। আবহমান বাঙালি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি গল্পে ফুটে উঠেছে। নারীর জীবনকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে পুরুষের কোনোই তৎপরতা দেখা যায়নি। বরং কিভাবে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে হবে, সেদিকেই যেন তাদের ঝোঁক।
মেয়েমানুষ দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায়। আমি তাই বলি, মেয়েমানুষের দুঃখ পেতেই হবে এইটে যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয় তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো, আদরে দুঃখের ব্যথাটা কেবল গড়ে ওঠে।৬
সন্তানহীন পরিবারে নারী মুখ বুজে সব মেনে দিয়েছে। তাকে নিয়ে স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাবনার কোনো লেশমাত্র নেই। কারণ সে নারী! তার ওপর পুত্রের স্ত্রী! আদর যত্নে তাই বাঁধন শক্ত করে তুলতে পারেনি।
মৃণালের নিজের দোদুল্যমান, অবস্থার মধ্যে এসে জড়ো হয় আর এক নারী চরিত্র। মৃণালের বড়ো জায়ের বোন বিন্দু। রবীন্দ্রনাথ ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণালকে প্রতিবাদী করে তুললেও বিন্দু পড়ে পড়ে লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। জীবনের চরমতম নিষ্ঠুর পরিস্থিতির শিকার বিন্দু। সে এই গল্পের আরও একটি প্রধান চরিত্র। বাবা-মাহীন বিন্দু খুড়তুতো ভাইয়েদের অত্যাচারের মুখে পড়ে টিকতে না পেরে বোনের বাড়ি আসে। কিন্তু সেই বোনও অসহায় মেয়েটির পাশে দাঁড়ায় না। কারণ একে তো উটকো ঝামেলা, তার ওপর তার তথাকথিত রূপ নেই। ফলে মুখবুজে অপমান হজম করতে হয়েছে।
অসহায় বিন্দু শ্রীহীন এবং পিতৃ-মাতৃহীন হওয়ার কারণে খুড়তুতো ভায়েরা তাকে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও দেয়নি বরং তাকে আপদ বলে বিদায় করে দিয়েছে। বোনের কাছে এসেও বোনের শ্বশুর বাড়ি তার জায়গা হয়েছে দাসীর মতো।
বিন্দুর বড় বোন অবহেলিত এবং পতিব্রতা স্ত্রী। স্বামীর মতের বাইরে গিয়ে নিজের রক্তের সম্পর্কের বোনের জন্যও মাথাগোঁজার সঠিক জায়গাটুকু নির্ধারণ করে দিতে পারেনি। এ বাড়ির বড় বউ হওয়ার যোগ্যতা নিজের মধ্যে কোনোদিন আবিষ্কার করেনি সে। কারণ সে শ্রীহীন। বাবার অর্থকড়ি নেই। তাই বোনের মতো এখানে নিজেকেও উপদ্রব মনে করে। সমাজব্যবস্থা তাকে তা মনে করতে বাধ্য করেছে। শ্বশুর ঘরে নারীর যোগ্যতা রূপ ও বাবার টাকা পয়সা। যদি এ দুটির একটিও না থাকে তবে বিন্দুর বড় বোনের মতো সংসারে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মতোই খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয়।
সমাজের গড়ে ওঠা প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কয়জন বড় বউয়ের লড়াইয়ের মনোবল আছে! তাই স্বামীর মত না থাকায় নিজের বোন বিন্দুকে অযাচিত উৎপাত ভেবে তাকে দাসীবৃত্তিতে নিযুক্ত করেছে। কারণ বোনকে দূরে ঠেলে দিতেও পারেনি। আবার প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে বোনের জন্য লড়াইও করেনি। পুরুষতন্ত্র তার মস্তিষ্কে ঠেসে বসে আছে। তাই স্বামীর বিরুদ্ধে, সংসার, সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেনি। এমনকি প্রকাশ্যে তার প্রতি স্নেহটুকুও দেখায়নি। বরং বিন্দুর বর, বোন সবার কাছে এটাই প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে, তার বোন সংসারের ব্যয় বরং কিছুটা কমাচ্ছে। কারণ বাড়ির সব কাজ সেই করে। সংসারে ফাঁকি দিয়ে বিন্দুকে সুবিধাদরে পাওয়া গেছে বলে স্বামীকে ও শ্বশুর ঘরের সবাইকে আস্বস্ত করে।
নারীর জীবন কতটা ভয়াবহ হয়ে আসছে তার প্রমাণ মৃণাল, বিন্দু, বিন্দুর বড় বোন। আলাদা ধরন-গড়ন হলেও তিন নারীই অবহেলিত। শেষমেশ মৃণাল প্রতিবাদী হয়ে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কিন্তু বিন্দুর বড় বোন সমাজের প্রচলিত ধারাকে শিরোধার্য করেছে। দিনের পর দিন মুখ বুজে নিজে অপমান হজম করেছে। বোনকেও অপমান সহ্য করার পথে ঠেলে দিয়েছে। বিন্দুর বোনের কাছে পতিই নারীর গতি ও পতি পরমেশ্বর, প্রভুরূপে স্বীকার্য। তাই শত লাঞ্ছনাও স্বাভাবিক মনে করেছে। কারণ তাকে তো শ্বশুর ঘরে দয়া করে বউ করা হয়েছে; এটা পরিবার-সমাজ মনে গেঁথে দিয়েছে। তাই আর যাই হোক তাদের সঙ্গে বিরোধে যাওয়া যায় না। বরং বোনের মাথার ছাদ না থাক নিজের মাথার ছাদটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে। সেখানে কতটা না পাওয়া, মান-অপমান তার হিসেব কষেনি।
বিন্দুর বড় বোনের মতো হাজারো বাঙালি নারী। তারা সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে নিজের সম্বন্ধে উদাসীন থাকে। পরিবারে গেলে সব দায়িত্ব নারীর এমন ধারণাই নারীকে বিপথে পরিচালিত করে। বিন্দুর বোন পতিব্রতা। সেখানে ফাঁক না থাকলেও স্বামীর দিক থেকে কোন শ্রদ্ধা সম্মান লক্ষ করা যায়নি বরং তাকে শোষণের সমগ্র দিক গল্পে বিদ্যমান। মৃণালের জবানিতে উঠে এসেছে নারীর জীবনের নিষ্ঠুরতম দিক।
আমাদের বড় জায়ের বাপের বংশে কুল ছাড়া আর বড়ো কিছু ছিল না, রূপও না টাকাও না। আমার শ্বশুরের হাতে-পায়ে ধরে কেমন করে তোমাদের ঘরে তাঁর বিবাহ হলো সে সমস্তই জান। তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি বিষম একটা অপরাধ বলেই চিরকাল মনে জেনেছেন। সেই জন্যে সকল বিষয়েই নিজেকে যতদূর সম্ভব সংকুচিত করে তোমাদের ঘরে তিনি অতি অল্প জায়গাজুড়ে থাকেন।৭
নারীর এই মানসিকতার জন্য একতরফা নারীকেই দায়ী করা যায় না বরং সমাজব্যবস্থাকেই আঘাত করতে হয়। নারীর জীবনকে এতটা তুচ্ছে এতটা সংকীর্ণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে বাধ্য করে পরিবার-সমাজ। নারীও এই বৃত্তাবদ্ধ জীবন ছেড়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারে না। কারণ সামাজিক নিরাপত্তা, মাথার ওপর নির্দিষ্ট ছাদ হারানোর ভয়! নাহলে একটি পরিবার কিভাবে তাকে গ্রহণ করলো, তার অধিকার, সম্মান-শ্রদ্ধা- সম্পর্কে এতটা উদাসীন! বিন্দুর বোন আর দশটা তথাকথিত নারী যারা আজীবন নিজেকে নিঃশেষ করে অন্যকে আলোকিত করে। কিন্তু ব্যতিক্রম মৃণাল। সে প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। নিজে যা না তার জন্য তার কোনো আক্ষেপ নেই আবার যা তার সেটা ছেড়ে দিতেও সে নারাজ।
পরিবারে নিজের অধিকার যখন রক্ষিত হয়নি তখন সে পরিবার ত্যাগ করে তীর্থে গেছে। যার মধ্যে পরিপূর্ণ মুক্তি খুঁজে নিয়েছে। নিজেকে অন্যের কাছে সমর্পণ করে খাটো করেনি বরং ভালো ও মন্দের বিভেদ ভুলে মুখ বুজে অন্যায় সয়ে যায়নি। মৃণাল তাই বিন্দুর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়কে সমর্থন করেনি বরং তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। কিন্তু বিন্দুকে ঘরে ও মনে ঠাঁই দেওয়াই পরিবারের সবাই তাকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। মৃণাল গরিবের ঘরের মেয়ের মাথা খেতে বসেছে। এমনটাই সবাই বলে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু এই অসহায় মেয়েটি সবার অন্তরালে মৃণালের আপনার হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। তার সব আকাক্সক্ষা মৃণলকে ঘিরে গড়ে ওঠে।
অবলা কোনো পশুও যদি ভালোবাসা পায়, তবে তাকে ঘিরেই বাঁচার আশা করে, ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাতর হয়ে ওঠে। মৃণাল যেমন নিজের অধিকার আদায় করতে গিয়ে পরিবার-পরিজনের রোষের শিকার হয়েছে, ঠিক তেমনি বিন্দুও অবাঞ্ছিত হওয়ায় অন্যের চক্ষুশূল হয়ে উঠলো। ফলে দুজন দুজনের পরম আশ্রয়, মমতা, ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে একে অন্যক আগলে রাখার ব্রত মনে গ্রহণ করে।
পরিবারগুলো নারীকে মানসিকভাবে পুরোপুরি আজও গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের আত্মশক্তি চেনাতে শেখেনি। ফলে নারী শুধু সংসার-সন্তান লালনকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছে।
মৃণাল লক্ষ করে বিন্দু তাকে পরম যত্ন করে, চুল বেঁধে দেয়, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। কিন্তু বিন্দুর বয়স চৌদ্দর কম ছিল না। তৎকালীন হিন্দু সমাজে এত বয়সী মেয়ের বিয়ে না হওয়া মানে একটা কুলক্ষণের ব্যাপার। কিন্তু বিন্দু সুশ্রী নয়। তার বাবা-মা নেই। এমনকি মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও নেই। তাই তার বিয়ের ব্যাপারে সবাই উদাসীন। খুড়তুতো ভায়েরা তাকে অনবশ্যক ভেবে এক কোণে ফেলে রাখতো। বোনের কাছে এসে সেখানেও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। একমাত্র আশ্রয় মৃণাল। যদিও আগলে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মৃণাল শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
বিন্দু একবার প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার বলে বসন্ত। সেটা শোনার পুরো পরিবার তাকে বয়কট করে। দেখতে সুশ্রী নয়, বাপের অর্থকড়ি নেই, সেই মেয়ে বাঁচলো কী মরলো, তাতে কারও কিছু এসে যায় না। বরং মরলে আপদ বিদায় হয়। বিন্দুর পাশে থেকে তাকে আগলে রাখে মৃণাল।
আমি বললুম, বসন্ত হয় তো হোক, আমি আমাদের সেই আঁতুড়ঘরে ওকে নিয়ে থাকব, আর কাউকে কিছু করতে হবে না। এই নিয়ে আমার উপরে তোমরা যখন সকলে মারমূর্তি ধরেছ, এমন-কি, বিন্দুর দিদিও যখন অত্যন্ত বিরক্তির ভান করে পোড়াকপালি মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাবার প্রস্তাব করেছেন, এমন সময় ওর গায়ের সমস্ত লাল দাগ একদম মিলিয়ে গেল। তোমরা দেখি তাতে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠলে। বললে, নিশ্চয়ই বসন্ত বসে গিয়েছে। কেননা, ও যে বিন্দু। ৮
মৃণালের চিঠির মাধ্যমে গল্পটি রবীন্দ্রনাথ বলে গেলেও গল্পের তেজস্বী রূপ কোথাও থমকে যায়নি। বরং মৃণালের প্রতিবাদী সত্তা পাঠকের গায়ের রোমকূপ খাড়া করে দেয়। বিন্দুর মতো অনাবশ্যক, অসহায় ও শ্রীহীন বস্তুসর্বস্ব নারীর প্রতি এর থেকে পরিবারের কোনো দায়িত্ব আশা করা যায় না। বিন্দুর মতো নারীরা আজও এ সমাজে অবহেলিত। কিন্তু বিন্দুকে ছাপিয়ে মৃণালের কণ্ঠে কয়জন কণ্ঠ মেলাতে পেরেছে! কতজন নারী নিজের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। বরং পুরুষতন্ত্রকে জয়ী ঘোষণা করে নীরবে নিভৃতে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
রবীন্দ্র যুগের সঙ্গে আজকের সমাজের পরিবর্তন বিপুল হলেও নারীর ভাগ্য বিড়ম্বনা কমেনি। এজন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যতটা দায়ী নারী নিজেও ততটা। কারণ শিশু না কাঁদলে মাও দুগ্ধ পান করায় না। ফলে নারীর শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে মৃণালের মতো নারীকেই আওয়াজ তুলতে হবে। অন্যায়কে না বলতে শিখতে হবে। নিরাপত্তা, সামজিক পদমর্যাদা, মাথার ওপর ঠাঁই হারানোর ভয়ে যদি নীরবে সয়ে যেতে হয়, তবে তা আরও বাড়াবে বৈ কমবে না। তাই মৃণাল হোক বাঙালি নারীর জীবনাদর্শ।
মৃণালের প্রতি বিন্দুর ভালোবাসা ক্রমশ এত বাড়তে থাকে যে, বাড়ির সবাই বিরক্ত হতে থাকলো। এরমধ্যে হুট করে মৃণালের ঘর থেকে বাজুবন্ধ চুরি হয়ে গেলে নিশ্চিতভাবেই বাড়ির সবাই বিন্দুর দিকে তীর নিক্ষেপ করতে এতটুকুও ভাবেনি। কারণ সে বিন্দু। রূপ-গুণ-টাকাকড়ি কোনো কিছুই তার নেই। আবার স্বদেশি হাঙ্গামায় যখন লোকের বাড়ি তল্লাশি হতে থাকে, তখনো বিন্দুর দিকে বন্দুকের গুলি তাক করা হয়। বিন্দু যে পুলিশের পোষা চর সে বিষয়ে তাদের সন্দেহ থাকে না। এর কারণও ওই একটাই, সে বিন্দু। তার পরিচায়ই তাকে শতবাধার সম্মুখীন করেছে। প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। কিন্তু অসহায় হয়ে সবার কথা উপেক্ষা করে একটু ঠাঁই পেতে চেয়েছে।
মৃণাল যতটা প্রতিবাদী, বিন্দু বা বিন্দুর বড় বোন ঠিক ততটাই নির্বিকার। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের অধিকারের পক্ষে কথা বলেনি। কারণ পরিবার-সামজ তাদের সে শিক্ষা দেয়নি। নারীদের পরিবার থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়, নারীরা পরিবারে-সমাজে যতই নিষ্পেষিত হোক, তাকে নীরবে সবকিছু মানিয়ে নিতে হয়। পরিবার বা সমাজের বিরুদ্ধে গেলে নারীর জীবনে বিপর্যয় ঘটবে। এই মানসিকতাই নারীকে শোষণ করতে সহযোগিতা করে। নারীরা শতবিপদে থাকলেও নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলে না। মৃণাল ব্যতিক্রম তাই বিন্দুকে আগলে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে কিন্তু বিন্দুর ভাগ্যদোষে সে সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।
ফল হিসেবে বিন্দুকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলে। বিন্দুর প্রতি ক্ষোভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বয়সও বেড়ে চলে। কিন্তু মৃণাল প্রতিবাদী হওয়ায় বিন্দুকে সহজে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারেনি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ফলে দুষ্টুবুদ্ধির জোরে বিন্দুকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর অপকৌশল খাটায়। কিছুদিনের মধ্যেই বিন্দুর বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ গল্পে তুলে ধরেছেন এভাবে,
অবশেষে বিন্দুকে নিজের শক্তিতে বিদায় করতে না পেরে তোমরা প্রজাপতিদেবের শরণাপন্ন হলে। বিন্দুর বর ঠিক হল। বড়ো জা বললেন, ‘বাঁচলুম। মা কালী আমাদের বংশের মুখ রক্ষা করলেন।৯
বিন্দুর বর ঠিক হলো তার সম্মতি ছাড়াই। এমনকি পাত্রপক্ষও বিন্দুকে দেখতে আসেনি। বিন্দুকে পশুর মতো বলি দিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে মৃণালও বিন্দুর জন্য প্রতিবাদ করতে পারেনি। কারণ বিন্দু মেয়ে। তার ওপর কালো। তাছাড়া বয়সও বেড়ে চলেছে। বিন্দুর ভালো-মন্দ বিচার না করে বরং সে প্রচলিত সমাজের মতো বিয়েতে আপত্তি করেনি মৃণাল। কারণ মেয়ে বড় হলে তাকে বিয়ে দিতে হয়। তার ওপর বিন্দুর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। ফলে মৃণালের অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকলেও সে মুখ বুজে থেকেছে। বিন্দু কোনোভাবেই অযাচিত বিয়ে মেনে নিতে পারেনি কিন্তু পরিবারের ঠাঁই যার মাথার ওপর নেই, তার জন্য একা লড়াই করা প্রায় অসম্ভব। বিন্দুও সেদিন নীরবে আত্মাহুতি দিয়েছে।
পরিবার-সমাজ আমাদের যেভাবে গড়ে তুলেছে, সেই বৃত্ত ভেদ করে মৃণালও বের হতে পারেনি। কারণ মৃণালও এই সমাজের প্রতিনিধি, নারীও। বাঙালি নারীর মুক্তি খোঁজে পুরুষতন্ত্রের সেবায়। পরিবার ও সমাজের ধারণা নারীর প্রকৃত মুক্তি বিয়ের মাধ্যমে ঘটে থাকে। কিন্তু পরিবার-সমাজের মানুষেরা একবারও ভাবে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর মুক্তি নারীর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। নারীর আত্মশক্তিতে। নারীর যোগ্যতায়। কিন্তু সমাজের বদ্ধমূল ধারণা পাল্টে মৃণালও পাশে দাঁড়াতে পারেনি এসময়। মৃণাল প্রতিবাদী হলেও সংস্কার ভেঙে বের হতে পারেনি বিধায় বিন্দুর বিয়ে আটকানো সম্ভব হয়নি। অদেখা অচেনা পাত্রের সঙ্গেই বিন্দুর বিয়ে হয়ে যায়। গোয়ালঘরেও বিন্দুর জায়গা হয়নি। বরং বিন্দুর বড় বোন বিন্দুকে এই বলেই সান্ত্বনা দেয়, ‘জানিস তো বিন্দি, পতিই হচ্ছে স্ত্রী লোকের গতি, মুক্তি সব। কপালে যদি দুঃখ থাকে তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না।’১০
মৃণালের বড় জায়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সংস্কার বাঙালির চিরন্তন রূপ। নারীর মূল্য এখানে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। পুরুষ চাইলে নারী খাবে, ঘুরবে। না চাইলে নারী শুধু পুতুলের মতো শোবিজ হয়ে থাকবে। বাঙালির মননে-চেতনায় আজও এই সংস্কার-প্রথা বিদ্যমান। আজও নারীকে এভাবেই অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। পরিবারগুলো নারীকে মানসিকভাবে পুরোপুরি আজও গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের আত্মশক্তি চেনাতে শেখেনি। ফলে নারী শুধু সংসার-সন্তান লালনকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছে।
‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে আবহমান বাঙালি নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, সে-সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই সমাজে বিন্দুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়। তাই মৃণালের মতো প্রতিবাদ না করলে এ সমাজে রক্ষা পাওয়া কঠিন।
সমাজে-রাষ্ট্রে নিজের অধিকার গ্রহণ করে নিজের পরিচয় গঠনে নারীরা আজও পিছিয়ে। বিন্দু অশিক্ষিত নারী। রাষ্ট্র তাকে অক্ষরজ্ঞান না দিতে পারলেও তার মেরুদণ্ড সোজা করার জন্য তাকে মানসিক শক্তিতে পূর্ণ করে তুলতে পারতো। কিন্তু রাষ্ট্র নারীর পূর্ণ সম্মান নিয়ে কখনো ভাবেনি। তবে সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। নারীরা মৃণালের মতো প্রতিবাদী হয়ে উঠছে।
বিয়েই নারী জীবনের মুক্তি এমন ধারণা থেকেই মৃণাল বিন্দুর বিয়ে আটকানো সম্ভব হলেও তা করেনি। বিয়ের পর যখন বিন্দু আবিষ্কার করে তার স্বামী পাগল, তখন আশ্রয় হিসেবে মৃণালের কাছেই ছুটে এসেছে। বিন্দু বলে, ‘মেয়েমানুষকে মেয়ে মানুষ দয়া করে না। বলে, ও তো মেয়েমানুষ বৈ তো নয়। ছেলে হোক-না পাগল, সে তো পুরুষ বটে।’১১
বিন্দুর শ্বশুর বাড়ির সবাই পাগল ছেলেকে জোর করে বিয়ে দেয়। কারণ সে তো পুরুষ। আর পুরুষের তো পাগল বা মন্দ দিয়ে সমাজ বিচার করে না। সমাজ বিচার করে বিন্দুর গায়ের রঙ কালো না ফর্সা, বিন্দুর বাবার অর্থকড়ি কতটা, বিন্দু কোন গুণে গুণান্বিত! বিন্দুর মতো নারীদের একশ্রেণির নারীরাই দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। নিজেও যে নারী নিজের স্বজাতির প্রতি অসম্মান মানে নিজের প্রতি অসম্মান, এতটুকু বোধ তাদের নেই। বিন্দুকে অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ করে তাই পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারে পাঠানো হয়। আজও সমাজব্যবস্থার মূলে এতটুকুও পরিবর্তন আসেনি। কিছু নারী নিজেই নিজেকে পণ্য করে তুলছে বোধহীনভাবে! চেতনা-বিবেক বর্জিত হয়ে নিজের আত্মসম্মান, শ্রদ্ধা খুইয়ে বিন্দুর বোন বা শাশুড়ির মতো মানসিকতায় পড়ে আছে। সেখানে আজও আলো পৌঁছেনি। অন্ধত্বের নিকষ অন্ধকারে নারী হয়ে নারীকেই দমিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছে পোষণ করে তারা।
পাগল স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পেতে বিন্দু শেষমেশ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু নারীর জীবন দোষময়। তার সব কাজের মধ্যে খুঁত খুঁজে বের করা সমাজের স্বভাব। তাই আগুন লাগিয়ে অসহায় বিন্দু মরে গেলেও সমাজ তাকে ছেড়ে কথা বলেনি। বরং পাগল পুরুষের সংসারে কেন জীবনকে নিঃশেষ করে দিলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দেশসুদ্ধ লোক চটে গিয়ে বলেছে, মেয়েদের গায়ে আগুন লাগিয়ে মরা ফ্যাশান! কী আজব সমাজ! কী আজব দেশ! যেখানে নারীর মরণও স্বাভাবিকরূপে নেয় না কেউ। বিন্দু বেঁচে থাকতে যারা নাক সিটকিয়েছে, তারাই সে মরলেও প্রশ্ন তুলেছে।
রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে নারীর এ হীন দশা বর্ণনা করে গেছেন। আজও নারীরা বিন্দুর মতোই ভাগ্যবরণ করছে। আজও বিন্দুদের বড় বোনেররা পতিকেই নারীর গতি ভাবছে। জীবনকে পুরুষের অধীন করে চলতে শেখাচ্ছে পরিবারগুলো!
রবীন্দ্র গল্পে তিনিই হাজারো বিন্দুর পক্ষে একজন মৃণালের স্বপ্ন দেখেছেন। যে পরিবার-সমাজের তোয়াক্কা না করে রীতি-নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে। একা বাঁচার স্বপ্ন লালন করেছে। মেয়েদের জীবনের শোচনীয় দিক নিয়ে ভেবেছে। সংসারে মেয়ে মানুষের পরিচয়টা যে কী, তা সম্পর্কে মৃণাল আক্ষেপ প্রকাশ করেছে। তাই মেয়ে হয়ে আর সংসারে ফেরা নয় বরং ভগবানের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে চেয়েছে। মৃণালের মতো গর্জে না উঠলে বাঙালি নারী আগামী দিনগুলোতেও ‘তড়পে তড়পে’ মরবে। আর পুরুষতন্ত্র তার ফায়দা লুটবে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী চরিত্র মৃণাল গর্জে উঠেছে আপন আলোয়।
তুমি ভাবছ আমি মরতে যাচ্ছি; ভয় নেই, অমন পুরোনা ঠাট্টা তোমাদের সঙ্গে আমি করব না। মীরাবাঈও তো আমারই মতো মেয়েমানুষ ছিল; তার শিকলও তো কম ভারী ছিল না, তাকে তো বাঁচবার জন্যে মরতে হয়নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, ‘ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু, তাতে তার যা হবার হোক। এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা। আমিও বাঁচব। আমিও বাঁচলুম।১২
প্রতিবাদ কতটা তেজস্বী, ঝাঁজালো হতে পারে তা রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবেই দেখালেন। মৃণালের সংসার ত্যাগ সমাজের ওপর জোর চপেটাঘাত। যেই সমাজে নারী তার আপন মায়া-মমতা আলো দিয়ে পরিবার পরিজন আগলে রেখে আলোকিত করে। সেই সমাজই নারীর দিকে আঙুল তোলে। নারীকে প্রতি পদে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে! মৃণালের মতো নারীরাই আজকের সমাজে টিকে থাকবে। নতুবা বিন্দুর মতো অকালেই হারিয়ে যাবে।
মৃণাল আগাগোড়া বিদ্রোহের প্রতিমূর্তি। এই বিদ্রোহ স্বামীর পরিবারের নিয়ম কানুনের বিরুদ্ধে যেমন, তেমনি রুগ্ণ মধ্যযুগীয় পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ-সমাজের বিরুদ্ধেও। বিন্দুর প্রতি সকলের অমানবিক ব্যবহার দেখে মৃণাল মধ্যযুগীয় মূল্যবোধহীন সমাজের চেহারাটা উপলব্ধি করেছে। এই জন্য সবরকম সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তার জেহাদ। মৃণাল বিন্দুকে দেখে উপলব্ধি করেছে সংসারে নারীদের অবস্থান কোথায়! এই জন্যই পত্নীত্ব থেকে নারীত্বের মহিমায় তার মুক্তিসন্ধান। ১৩
মৃণালের প্রতিবাদী ভাষাই হোক প্রতিটি বাঙালি নারীর প্রাণের ভাষ্য। ‘
‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে আবহমান বাঙালি নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, সে-সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই সমাজে বিন্দুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়। তাই মৃণালের মতো প্রতিবাদ না করলে এ সমাজে রক্ষা পাওয়া কঠিন। সমাজের কুসংস্কার, অন্ধত্ব দূর করার জন্য প্রত্যেক বাঙালি নারীকে হতে হবে মৃণালের মতো তেজস্বী। তবেই পরিবারে-সমাজে নারীর সম্মান বাড়বে।
তথ্যনির্দেশ
১. বিশ্বজিৎ ঘোষ, অশেষ রবীন্দ্রনাথ, নান্দনিক, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ. ৮০
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, মৌ প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০১১, পৃ. ৩৩০
৩. তদেব, পৃ. ৩৩০
৪. তদেব, পৃ. ৩৩০
৫. তদেব, পৃ. ৩৩০
৬. তদেব, পৃ. ৩৩১
৭.তদেব, পু.৩৩১
৮. তদেব, পৃ.৩৩১
৯. তদেব, পৃ. ৩৩২
১০. তদেব, পৃ. ৩৩২
১১. তদেব, পৃ. ৩৩৩
১২.তদেব, পৃ. ৩৩৫
১৩. হীরেন চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণগোপাল রায় ( সম্পাদনা), সাহিত্য -প্রবন্ধ : প্রবন্ধ সাহিত্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ৭১৫