০১.
ভারতীয় উপমহাদেশের নারীসমাজ পণপ্রথার মত একটি বিষাক্ত সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে দীর্ঘকাল থেকে। এবং ক্রমে ক্রমে এর ভয়াবহতা ব্যাপকহারে বেড়ে পণের দায়ে ফাঁসির যূপকাষ্ঠে বলি হতে হচ্ছে অসহায় নিরীহ মেয়েদের। গণতান্ত্রিক দেশে এই অগণতান্ত্রক ব্যাধি নির্মূল করার জন্য আইন তৈরি করতে হচ্ছে সকলকে। রবীন্দ্রনাথ পণপ্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি একে ‘লজ্জাজনক এবং অপমানকজনক’ প্রথা বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কারে তিনি সোচ্চার হয়েছেন : ‘পণপ্রথার ন্যায় লজ্জাজনক ও অপমানজনক প্রথা আর নাই। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দোকানদারী দিয়া আরম্ভ করা, যাহারা আজ বাদে কাল আমার আত্মীয়শ্রেণীতে গণ্য হইবে, আত্মীয়তার অধিকার স্থাপন লইয়া তাহাদের সহিত নির্লজ্জভাবে নির্মমভাবে দর-দাম করিতে থাকা, এমন দুঃসহ নীচতা যে সমাজে প্রবেশ করিয়াছে, সে সমাজের কল্যাণ নাই’।
তিনি আত্মীয়তা সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দরদাম করার মত ব্যবসায়িক মানসিকতাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করেছেন। আমাদের দেশে সরকারী আইন পণপ্রথাকে রদ করতে পারছে না বলেই এত বধূহত্যা, নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দিন দিন বাড়ছে। পণপ্রথা-বিরোধী রবীন্দ্র-মানসের স্বরূপ বর্ণনার আগে পণপ্রথার মত সামাজিক ব্যাধি নিয়ে উপক্রমণিকা হিসেবে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যেতে পারে।
বরপণ দেবার সূত্রপাতটি সেই মধ্যযুগে যখন ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল তখন কে জানতো, সেই হাসতে হাসতে বরপণের খেলা একদিন জীবন খেলার মারণযন্ত্রে রূপান্তরিত হবে। মহাভারতের শল্য-পর্বে বৃদ্ধা রূপহীনা কন্যা সুক্রর প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে যে, সমর্থবান পিতা একদিন তাঁর কুরুপা মেয়েকে নির্ভরযোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দেবার জন্য, বরং বলা যায় কিছুটা পাত্রের সন্তুষ্টিকরণ ভেটের মতই একসময় কিছু অর্থ সম্পদ বা শুল্ক তুলে দিয়েছিলেন বর-এর হাতে। সেই অনায়াসে তুলে দেয়া ব্যক্তিগত ধনসম্পদই কালের বিবর্তনে সামাজিক প্রথায় রূপ পেল; ভয়াবহ আকারে ডালপালা বিস্তার করে মেয়ের বাবার সামর্থ্য পাওনাদারের রোলার দণ্ডে রূপান্তরিত হলো। সুস্থ সমাজ জীবনে যা সারাক্ষণ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মনে অশুভ করাল ছায়ার ন্যায় আগ্রাসী হাতের স্পর্শ লাগার মতই আতংকের সৃষ্টি করছে। দিন দিন আমরা কৃত্রিম সভা হচ্ছি, প্রগতির রথে এগিয়ে যাচ্ছি, পৃথিবীর বুকে ভারতের আসন শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত হোক এই কামনা করছি, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শ্লোগান তুলছি, মানবিক তথা নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলছি এবং ঢাক ঢোল পিটিয়ে নারী-উন্নয়ন দশক পালন করেছি। অথচ ভেতরে ভেতরে বংশপরম্পরায় রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা পণপ্রথাকে মনের অজান্তেই, উর্বরতা দেবার জন্য লালন করছি; পণ নেবার ব্যাপারে ঔদার্য দেখাচ্ছি। সেই মুহূর্তে একবারও ভাবছি না এই অবচেতন মনের সযত্নলালিত পণপ্রথার উর্বর শক্তিশালী আঘাতে একদিন আমিও চূর্ণবিচূর্ণ হতে পারি। একবারও সচেতন মন নিয়ে ভাবছি না যে, এটি একটি অবচেতন প্রতিশোধস্পৃহাজাত বিষাক্ত সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধি মানুষের মনুষ্যত্বকে হেয় করে—স্ত্রী সহধর্মিনী, সহকর্মিনী, সহমর্মিনী না হয়ে, হয়ে যায় দাসী, পরিচারিকা কিংবা বাজার থেকে কিনে আনা পণ্যবস্তু। সেই স্ত্রী স্বামীর কথায় কাদে, হাসে, স্বামীর মনমতো ‘সোসাইটিতে’ মেশে এবং সভ্যতার চাপে অতি সুখী দম্পতির সুনিপুণ অভিনয়ও করে। কিন্তু পণের চাপে বাবাকে নিঃস্ব করে আসা মেয়ের মনের গভীরে যে ক্ষত দিনে দিনে বেড়ে উঠতে থাকে; সেই ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণের খবর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্তব্যপরায়ণ স্বামী কোনদিনই রাখেন না কিংবা স্ত্রীর মনের নাগাল কোনদিনই পান না। নিজের মা-বাবা ভাই-বোন, পরিচিত আবেষ্টনী ছেড়ে স্বামীর আপনজনকে নিজের বলে মেনে নিতে হয়। শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যোগ দিয়ে নিজের অনিচ্ছাকেও ইচ্ছায় পরিণত করতে হয়। এর প্রতিবাদ করতে গেলেই কিংবা নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেই দেখা দেবে সংঘাত—তার চরিত্রে লেপে দেয়া হবে কলংকের তিলক এবং পরিণাম হয়তো হবে আরো ভয়ংকর। আর যারা নীরবে আঘাত হজম করেন, তাদের মনের ভেতরে যন্ত্রণা হয় আরো গভীর। এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সব দিকে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়েই অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে পারিবারিক সুখের রশিটি টেনে রাখার দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মেয়েদেরকে বিশেষণ নিতে হয় ছলনাময়ী বলে; শুনতে হয় নারীর মন দেবতারও অগোচর।’
একটি মেয়েকে জন্ম নেবার পর থেকেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তোমার স্থান ভাইয়ের পরে, আগে নয়। আর একটু বড় হলে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় সে মেয়ে, এ ঘর তার নয়। তাকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে পরকে আপন করার; স্বামীর ঘরই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। তাই বাবার ঘর থেকে তার স্থান হয় শ্বশুরের কিংবা স্বামীর ঘরে। হায়রে ভারতের দুর্ভাগা নারী। নিজের ঘর আর তার হয় না কখনো। তাই ব্যক্তিইচ্ছার মৃত্যু ঘটাতে না পারলে সমাজে কোনো নারী হয় ভয়ংকরী, কেউ ছলনাময়ী, কেউবা আবার কলহপরায়না। আর যে নারী ইচ্ছার সম্পূর্ণ অপমৃত্যু না ঘটিয়ে সংসারে শান্তি চায়, তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হয়তো একদিন ঢলে পড়তে হয় মৃত্যুর কোলে। এই দৃষ্টান্ত অব্যাহত গতিতে বেড়েই চলেছে আজো। আসলে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীকে সম্পদ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এ এক বিচিত্র প্রক্রিয়া। যুগ যুগ ধরে শোষণের এই কূট-কৌশল সমাজে শিকড় গেড়ে বসে আছে। এই প্রথা সমাজে বিদ্যমান বলেই পণের বলি এবং বধূনির্যাতনের পরিসংখ্যান দিনদিন বেড়েই চলেছে।
০২.
পণপ্রথাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠা নারীর যন্ত্রণাকে রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছে’র প্রথম খণ্ডে লেখা ‘দেনাপাওনা’ গল্পটির মধ্য দিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার বরং বলা ভাল পণদায়গ্রস্ত দেনাদার পিতা এবং সেই দেনার দায়ে বিবাহিতা কন্যার জীবনের ভয়ংকর পরিণতিকে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ অভ্যস্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে পণের কবলে পতিতা কন্যার মর্মবেদনার সার্থক ভাষাচিত্র এ গল্পে নির্মান করেছেন।
‘দেনাপাওনা’ নামকরণের মধ্য দিয়েই পণপ্রথার প্রতি রবীন্দ্রনাথের তীব্র ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। গল্পটি এরকম: মেয়ের বাবা রামসুন্দর একজন সাধারণ মানুষ। পাচ ছেলের পর একটি মেয়ের জন্ম হল তার। বড় আদরের সে মেয়ে, নাম নিরুপমা। যথাসময় মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হলেন বাপ। তার একমাত্র কন্যার জন্য তিনি যে পাত্র খুঁজে আনলেন, সে ক্ষয়িষ্ণু রায়বাহাদুরের পুত্র, যার বাজারদর নিরুপমার বাবার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি মিলিয়েও নাগাল পাবার মত নয়। অর্থাৎ পাত্র ডেপুটি মেজিস্ট্রেট। তবু দরিদ্র পিতা তাঁর একমাত্র মেয়েকে সুখী দেখার জন্য অর্থাৎ আর্থিক ক্লেশমুক্ত ঐশ্বর্যময়ী রূপে দেখার জন্য একটি নামী দামী ঘরে বিয়ে দিতে চেয়েছেন। ঐ বর কিনতে হলে দশ হাজার টাকা লাগবে এবং বহু দান সামগ্রী। কিন্তু ‘কিছুতেই টাকার যোগাড় আর হয় না। বাঁধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া অনেক চেষ্টাতেও ছয় সাত হাজার বাকি রহিল।’১ এ অবস্থায় বরের পিতা রায়বাহাদুর মহাশয়, তাঁর পক্ষে যা-ই বলা স্বাভাবিক তাই বললেন : ‘টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না।’২ এই দৃষ্টান্ত আজো চোখে পড়ে। এখনও পনের টাকা হাতে না পেলে বরকে বিয়ের পিড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
শুধুমাত্র তাই সংকটপন্ন অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ বরকে অতিমাত্রায় প্রতিবাদী করে তুলেছেন। দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রাপ্তির ব্যাপারে এযুগের বরেরাও এ ধরণের কথা বলে না, বরং বাবার বাধ্য ছেলে সেজে বিয়ের পিড়ি ছেড়ে উঠে যায়। নিরুপমার বর তার রায়বাহাদুর বাবাকে বলে বসলো : ‘কেনা বেচা দর-দামের কথা আমি বুঝি না; বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইবো।’৩
অতএব রায়বাহাদুরের নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর ছেলের সঙ্গে নিরুপমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে হলো বটে কিন্তু দেনা-পাওনার সম্পর্কটা ঘুচে গেল না। একমাত্র আদরের নিরুপমা; রামসুন্দর মেয়েকে না দেখে থাকতে পারেন না। মেয়েকে তিনি তার শ্বশুর বাড়িতে দেখতে যায় বটে কিন্তু বেয়াই বাড়িতে তার কোন প্রতিপত্তি নাই, চাকরগুলো পর্যন্ত তাহাকে নিচু নজরে দেখে। অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনদিন বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনদিন বা দেখিতে পান না।’৪ এতো গেল মেয়ের বাপের অবস্থা। মেয়ের অবস্থাও ততোধিক শোচনীয়। উঠতে বসতে নিরুকে টাকার জন্য খোঁটা খেতে হয়, বিনাদোষে কুৎসিত মন্তব্য শুনতে হয়। মানসিক যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত নিরুপমা, বাপের অবস্থাটা আঁচ করতে পেরে দিন কয়েকের জন্য বাপের বাড়ি যেতে চেয়েছে। কিন্তু নিরুপায় রামসুন্দর নিষ্ফল যন্ত্রণায় মাথা কুটেছেন : ‘নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে। এমনকি কন্যার দর্শন সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময় বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না।’৫ সেই বাবা মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবে কোন সাহসে, কোন যোগ্যতায়?
‘ডেপুটি মেজিস্ট্রেট’ স্বামীর অনুপস্থিতিতে অত্যাচারিতা নিরুপমার পক্ষে শ্বশুরবাড়ি ক্রমে ক্রমে ‘শরশয্যা’ হয়ে উঠলো। এবং ‘বেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না—যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইলো, সেই দিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেই দিনই ডাক্তারের দেখা দেশ হইলো।
মেয়েকে বাপের বাড়ি আনার জন্য, গঞ্জনার হাত থেকে একটু রেহাই দেবার জন্য শেষ পর্যন্ত রামসুন্দর বহু অপমান, বহু ক্ষতি স্বীকার করে, বহু কষ্টে তিন হাজার টাকা যোগাড় করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মেয়েকে সুখে রাখার যে কল্পিত আকাংক্ষা পিতার মনে দল বেঁধেছিল ইতোমধ্যেই তা মিটে গেছে। টাকাটা চাদরের কোণে বেঁধে নিয়ে রামসুন্দর সহাস্যমুখে বেয়াইর কাছে গেলেন বটে কিন্তু ‘পঞ্জরের তিন খানি অস্থির মত ঐ তিন খানি নোট” ৬ তিনি বেয়াইর সামনে তুলে ধরলেন। এত কষ্টে সংগৃহীত হলেও টাকাটা যেহেতু পুরো পাওনা শেষ নয় (বাকি ছিল ৭০০০ টাকা), তাই ঐ সামান্য টাকা নিয়ে বেয়াইমশাই আর ‘হাত দূর্গন্ধ’ করতে চাইলেন না। কাজেই মেয়েকে বাড়ি নিতে পারার অনুমতিও মিললো না। রাসু মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিত হস্তে নোট কয়খানি চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন। ততদিন আর বেহাই বাড়ি যাইবেন না।’ ৭ কিন্তু কোনোভাবেই যখন পুরো টাকাটা যোগাড় করতে পারলেন না রামসুন্দর, তখন ছেলেদের অজ্ঞাতে তিনি বসতবাড়ি বিক্রি করে বসলেন বরপণের দেনা শোধ করার জন্য যাতে করে বিয়ের অপরাধে আসামী মেয়ের ওপর থেকে ওয়ারেন্ট তুলে নিয়ে তাকে জামিনে ঘোরাফরা করার মত একটু সুযোগ করে দেয়া যায়। কিন্তু সেই ন্যূনতম অধিকারটুকু ফিরিয়ে দিতেও কত বাধা। যখন টাকা নিয়ে মেয়ের কাছে গেলেন রামসুন্দর, খবর জানতে পেরে তাঁর ছেলে ও নাতিরা হাজির হলো সেখানে। ছেলে বললো, ‘বাবা আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে?‘৮ নিরুপমা সব বুঝতে পারলো। সার্বিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ওর স্বাধিকার বোধ ও ব্যক্তি মর্যাদাবোধ তীব্র হলো। ও বাবাকে বললো : ‘টাকাটা যদি দাও, তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোন মর্যাদা নেই। আমি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে, ততক্ষণ আমার দাম না বাবা এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান করো না। তাছাড়া আমার স্বামীতো এ টাকা চান না।’‘৯ স্বামীকে এখানে উদার করে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে রবীন্দ্রনাথ চান ‘স্বামীরা’ এমনি উদার মানসিকতারই হোক। কিন্তু আজকের সমাজেও শ্বশুরবাড়ির প্রাপ্তি গ্রহণে কুণ্ঠিত, এমন অনুদার স্বামী বড় একটা চোখে পড়ে না। মেয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ের কাছে পরাভূত হয়ে রামসুন্দর এবারও কম্পিত হস্তে টাকাগুলো নিয়ে ফিরে গেলেন। কিন্তু টাকা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা গোপন রইলো না। ‘ডেপুটি মেজিস্ট্রেট’ স্বামীর অনুপস্থিতিতে অত্যাচারিতা নিরুপমার পক্ষে শ্বশুরবাড়ি ক্রমে ক্রমে ‘শরশয্যা’ হয়ে উঠলো। এবং ‘বেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না—যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইলো, সেই দিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেই দিনই ডাক্তারের দেখা দেশ হইলো।’১০
রায়বাহাদুর বাড়ির বড় বৌ-এর শ্রাদ্ধ খুব ঘটা করেই হলো। রামসুন্দরের কাছে সান্ত্বনাবাণী পৌঁছলো, কত সমারোহে তাঁর মেয়ের শ্রাদ্ধ হয়েছে। তার অন্তরের ঘা বাইরে বেরুবার সুযোগ পেল না কোনোদিন। স্ত্রীর মৃত্যু সম্পর্কে, এতবড় উদারস্বামী, যিনি পুরো পণের টাকা না পেয়েও স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন, তিনি এতসব ঘটনার কিছুই জানলেন না। তিনি এতদিন। বাদে তাঁর স্ত্রীকে নিজের কাছে পাঠিয়ে দিতে লিখলেন। তাঁর মা জবাব দিলেন : ‘বাবা তোমার জন্য আর একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি। অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে।’১১ এবার পণের অংক দ্বিগুণ “বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।‘১২
রবীন্দ্রনাথের এই গল্পটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় :
ক. বরের পিতা-মাতার পণের টাকার খাই প্রচণ্ড। এবং বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায়ও ঐ একই চিত্র বিদ্যমান।
খ. পণের টাকা মেটানোর জন্য পিতাকে সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়। এই চিত্র এখনও এতটুকু স্নান হয়নি। সমাজে তা এখনও বিদ্যমান।
গ. এখনও নিরুপমার মত পণের টাকা পরিশোধ না করতে পারায় কনেকে বাপের বাড়িতে যেতে দেয়া হয় না।
ঘ. পণের টাকা না দিতে পারায় নিরুপমার ওপর যে নির্যাতন, এখনও তা সমাজে বহাল তবিয়তেই রয়েছে।
ঙ. পণের শেষ পরিণতি বধূর মৃত্যু। এর নাম কি পক্ষান্তরে আত্মহত্যার পথে প্ররোচিত করা নয়?
রবীন্দ্রনাথ এই গল্পের মধ্য দিয়ে পণপ্রথার পরিণতির চিত্র তেমন দেখিয়েছেন, তেমনি অর্থগৃধুতার দৃশ্যপটও নির্মাণ করেছেন। কিন্তু এই গল্পে ‘পরিণতি’-এর প্রতিকার নেই। অবশ্য এখনও ময়নাতদত্ত ছাড়াই এমনিভাবে বহু বধূকে নীরবে পণের বলি হতে হয়, যেখানে আইনের ফাঁস দিয়ে বধূ-মৃত্যুর নায়কদের সোপর্দ করা যায় না। পণপ্রথার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের এই সোচ্চার-মানসিকতা আজকের দিনের মানুষের প্রতিবাদের মন্ত্র হওয়া উচিত।
রবীন্দ্র-গল্পগুচ্ছের তৃতীয় পর্বের গল্প ‘হৈমন্তী’। স্বভাবতই এ গল্পের প্রকাশভঙ্গীতে ঋজুতা এবং সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা ও বিচিত্রমুখীনতা ঝরে পড়েছে। এটি একটি স্মৃতিচারণমূলক গল্প। এখানেও শ্বশুরের অর্ধগৃধুতার স্বীকার হয়েছে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হৈমন্তী। স্বামীর রস- সমৃদ্ধ ভালবাসা পেয়ে হৈমন্তী শ্বশুরকূলের নির্লজ্জ অর্থগৃধুতার প্রতিবাদে আত্মঅবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে গেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে তাঁর করুণ পরিণতিকে আরো দ্রুততর করেছে মাত্র।
এ গল্পের পণগ্রহীতা, হৈমন্তীর শ্বশুরমশাই-এর অর্থ-পৈশাচিকতা প্রত্যক্ষ পণপ্রথার ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। শুধু বিয়ের আসরে চুক্তিবদ্ধ পণের টাকা পেয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকেননি—তাঁর লোভের শিকড় আরো গভীরে লুক্কায়িত ছিল। নিজের কল্পিত আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন এবং হৈমন্তীর প্রতি সেই যন্ত্রণার বিষ অযথা বর্ষণ করে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। গল্পটি এরূপ গল্পের নায়ক তথা পাত্র অপূর্ব। কনে হৈমন্তী। কলেজে পড়া যুবক অপূর্বর বিয়ে ঠিক হলো পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোনো এক রাজার অধীনে চাকুরীরত গৌরীশংকরবাবুর একমাত্র কন্যা হৈমন্তীর সঙ্গে। হৈমন্তীর বয়স ষোল। তবে ‘সে স্বভাবের ষোল, সমাজের ষোল নহে।’১৩ বিদুষী সংযত সহজ অনাড়ম্বর অথচ প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী হৈমন্তী। ছেলের বাবা গৌরীদানের পক্ষপাতী হলেও হৈম’র ষোল সতের বছর বয়সকে মেনে নিতে আপত্তি নেই। ‘মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গিয়াছে বটে কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনও তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যই তাড়া।’১৪ অর্থাৎ পণের অংক পনের হাজার এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা। যা দেবার কথা সবটাই গৌরীশংকরবাবু দিয়েছেন, চড়া সুদে টাকা ধার করে; বইপ্রেমী, ধীর, শান্ত, সংযমী মানুষ তিনি, একথা কাউকে বুঝতে দেন নি। অপূর্ব’র বাবা-মা কল্পনা করে। নিয়েছিলেন বেয়াই বুঝি রাজার অধীনে মন্ত্রীগোছের একটা বড় চাকুরী করেন এবং ভবিষ্যতে তাঁর অবসরের পর একমাত্র জামাই অপূর্ব ঐ পদে স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে; ব্যাঙ্কেও কমপক্ষে লাখখানেক আছে যার উত্তরাধিকারী পরোক্ষে অপূর্ব-ই। কিন্তু সত্যভাষী গৌরীশংকরবাবু কখনই কাউকে বলেননি, তিনি মন্ত্রীর চাকুরী করেন কিংবা ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকা সঞ্চিত আছে। অতএব ভবিষ্যতে প্রাপ্তির লোভে অনুমাননির্ভর মন্ত্রীগোছের বেয়াইর মেয়েকে যথাযথ বৌ-র মর্যাদা দিতে প্রথম অবস্থায় ওরা কার্পণ্য করেনি। কিন্তু যেদিন। ছেলের বাবার স্বপ্নভঙ্গ হলো, তারপর থেকে শুরু হলো হৈমন্তীর ওপর মানসিক অত্যাচার। অপূর্বর ভাষায় : যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনদিন কোন আলোচনাই হয় নাই, তবু বাবা জানিনা কোন যুক্তিতে ঠিক করিলেন, তাহার বেয়াই তাহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।’১৫ হৈমর প্রতি অত্যাচারের সঙ্গে মিথ্যে ভাষণ যখন যুক্ত হলো, ওর ঋষিতুল্য বাবাকে যখন ‘ঋষিবাবা” বলে ব্যঙ্গ করতে শুরু করলো, হৈমন্তীর আঘাত মরমে গভীরভাবে প্রবেশ করলো তখন থেকেই। মনের যন্ত্রণাকে শিক্ষা, রুচি ও সংযম দিয়ে ঢেকে রাখতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গন ধরেছে ভয়ংকরভাবে। একদিন হৈমর বাবা এলেন, হৈম কাঙালের মত হাহাকার করে উঠলো বাবার সঙ্গে যাবার জন্য। বাবা মেয়েকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হলেন, কিন্তু বইপ্রেমী আপনভোলা মানুষটি বুঝতে পারলেন না, বেয়াইবাড়িতে আগের মত যত্ন তাঁর নেই; বাপের সঙ্গে মেয়ের যাবার অনুমোদনেও বাঁধা পড়বে। বিয়ের শর্তানুযায়ী ষোল আনা যৌতুক দিয়েও তাঁর অপরাধ তিনি মন্ত্রীগোছের চাকরি করেন না; তাঁর অপরাধ, তাঁর নামে ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকা সঞ্চিত নেই। তাই ডাক্তার এনে মেয়েকে দেখানোর পর ডাক্তারের মুখ থেকে মেয়ের রোগের ভয়াবহতা যখন শুনেছে, তখন পাল্টাভাবে তাকে এ ব্যঙ্গও শুনতে হয়েছে, অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পণ্ডিতের-ই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারের কাছে সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।’১৬ যে ভয়াবহ পরিণাম ‘দেনা পাওনায়’ দেখা গেল অনুরূপভাবে এ গল্পেও নায়ককে ‘বুকের রক্ত দিয়ে দ্বিতীয় সীতা বিসর্জনের কাহিনী”১৭ লিখতে হলো। সূক্ষ্মভাবে দেখতে গেলে, ‘দেনা পাওনার চেয়ে ‘হৈমন্তী’ গল্পের পণগ্রহীতার চাহিদা আরো বেশি অনমনীয়; আরো বেশি সাংঘাতিক লোভের দৃষ্টি এদের। তাহলে দেখা যাচ্ছে পণপ্রাপ্তির ভয়ঙ্কর লালসা ছাড়াও বিয়ের পরবর্তী আরো একটি ‘পণতুল্য’ ঘৃণ্য আকাঙ্ক্ষা পরবর্তী জীবনকেও বিষময় করে তুলতে পারে। ‘হৈমন্তী’ গল্প তার প্রমাণ।
প্রাগুক্ত গল্পদুটিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে পণপ্রথার কবলে পতিত ভারতবর্ষের বিশেষত বাংলার মেয়েদের জীবনের শোচনীয় পরিণামকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু গভীর প্রতায়ী আশাবাদী রবীন্দ্রনাথ এর পাশাপাশি পণগ্রাহকদের হীনমন্যতার বিরুদ্ধে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা এবং বিবাহলগ্না কন্যাকেও বিদ্রোহী করে তুলেছেন তাঁর ‘অপরিচিতা’ গল্পে। এটি নিঃসন্দেহে পণপ্রথার তথা বরপক্ষের দুষ্টলোভের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। গল্পটির রচনাকাল ১৩২১ সালের কার্তিক মাস। অর্থাৎ আজ থেকে ৯১ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ, মা ষষ্ঠীর কৃপায় পুত্রসন্তানলাভকারী হীনলোভী শোষনেচ্ছু পিতাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কনে তথা কনের পিতাদের ব্যক্তিমর্যাদা নিয়ে গর্জে ওঠার মন্ত্র শুনিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন এই ‘অপরিচিতা’ গল্পটিতে।
এ গল্পের বক্তা পাত্র অনুপম স্বয়ং। তিনি এম. এ. পাস কিন্তু অভিভাবক (মামা) হীন চলার যোগ্যতা তাঁর হয় নি আজো। যথাসময়ে অনুপমের বিয়ের খোঁজখবর করা শুরু হলো। ছেলে বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকমামা রীতিমত শোষক এবং প্রভু-অভিভাবক সেজে বসলেন। ‘ধনীর কন্যা তার পছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তার অস্তিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। যাহাকে শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাধা হুকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না…. মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাহার কাছে গুরুতর।’১৮
এ ক্ষেত্রেও মেয়ের বয়স পনের। বয়সটা আপত্তিকর হলেও টাকার অঙ্ক গহনার ভরি- ওজন ও দর সব পাওয়ানা এককথায় মিটে যাওয়ায় এবং মেয়ের বাবা শম্ভুনাথ সেনকে স্বল্পভাষী চুপচাপ দেখে তাকে নির্জীব তেজহীন ভেবে নিয়ে বয়সের আপত্তিটি শিথিল হয়ে গেল। ধূমধাম করে গায়ে হলুদের পর্ব সমাধা করলেন ছেলের মামা, মেয়ের বাবাকে নাজেহাল করার জন্য। বিয়ের আসর সাজানো হয়েছে মাঝারী ধরনের, মামার তা মনোপুত হলো না। বিয়ের কাজ শুরু হবার আগেই মামা কনের গয়নাগুলোর গুণাগুণ এবং ওজন যাচাই করে নিতে চাইলেন। আর এর জন্য তিনি বাড়ির স্যাকরাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। মেয়ের বাবা তা শুনে মনোক্ষুণ্ণ হলেও বাইরে তিনি স্থির অবিচল। বিয়ের বরকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি তারও স্যাকরা দিয়ে গয়না যাচাই করার অভিমত কিনা? বলা বাহুল্য পাত্র অনুপমের নিজস্ব কোন ভাষা নেই। সে মামার ভাষায়ই সম্মতি জানায়। মেয়ের গা থেকে সব গয়না খুলে আনার পর মামা একটা নোট বুক নিয়ে একে একে সব গয়নার হিসেব টুকে নিলেন। গয়নাগুলোর গুণাগুণ এবং ওজন যাচাই করে জানা গেল, সেগুলো সর্বাংশে খাঁটি এবং তার ওজন বরপক্ষের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। অবশেষে একজোড়া ‘এয়ারিং” এনে শম্ভুবাবু স্যাকরাকে দিয়ে তার গুণাগুণ যাচাই করতে বললেন। স্যাকরা জানালো ঐটি সমস্ত গয়নার মধ্যে গুণমানে নিকৃষ্টতম। অর্থাৎ প্রচুর ভেজালযুক্ত সোনা। মামার মুখ লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়। কারণ ঐ ক্ষুদ্র নিকৃষ্ট গয়নাটি দিয়েই মামা কনের আশীর্বাদ-পর্ব সমাধা করেছিলেন। এরপরের অংশটি চমকপ্রদ। মামা ঘনঘন তাড়া দিচ্ছেন বিয়ের কাজ শুরু করার জন্য, লগ্ন যে বয়ে যায়। কিন্তু শম্ভুবাবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপও না করে সকল বরযাত্রীদের অত্যন্ত যত্নসহকারে খাইয়ে দাইয়ে খুব শান্তভাবে বললেন : ‘তবে আপনাদের গাড়ি বলিয়া দি।‘১৯ মামা অবাক হচ্ছেন, ঠাট্টা নয় তো! শম্ভুবাবু জানালেন : ‘আমার কন্যার গহনা চুরি করিব, একথা যারা মনে করেন, তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।’২০ চরম অপমানিত হয়ে দাম্ভিক মামাকে পাত্রকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হলো। এ প্রসঙ্গে অনুপমের ক্ষেদোক্তি : ‘সমস্ত বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাবা বিবাহের আসর হইতে ফিরাইয়া দিয়াছে।’২১ বরযাত্রীরা বলাবলি করিল বিবাহ হইল না, আমাদের ফাঁকি দিয়া যাওয়াইয়া দিল। পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অশুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া আসিতে পারিলে তবে আপশোস মিটিত।’২২
কাহিনী এখানেই শেষ নয়। এর কিছুদিন পর অনুপম মামাকে নিয়ে তীর্থভ্রমণে গেছে। পথিমধ্যে ট্রেনের একই কামরায় দেখা হয়েছে এক অপরুপা সুন্দরী শিক্ষিতা যুবতীর সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কয়েকটি ছোট ছোট মেয়ে। এই যুবতী ট্রেনে চলাকালীন কয়েকবার বিভিন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে সহযাত্রী হিসেবে অনুপমকে রক্ষা করেছে। অনুপম মুগ্ধ, মোহিত। পরিচয় নিয়ে সে জানলো, এই যুবতীর নাম কল্যাণী (বাবা শম্ভুনাথ সেন, কানপুরের একজন বড় ডাক্তার), যার সঙ্গে অনুপমের বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। অনুপম পুনরায় কল্যাণী এবং ওর বাবার কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করে বিয়ে করার বাসনা। প্রকাশ করলো। কিন্তু এবারও তাকে বিফল হতে হলো। কল্যাণীর বাবা একটু নরম হলেও কল্যানী নিজেই বিয়ে করতে কিছুতেই রাজি হলো না। সেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ও মেয়েদের শিক্ষারব্রত গ্রহণ করেছে। মেয়েরাও যে মানুষ, পুরুষ শাসিত সমাজের দেনা পাওনার ঊর্ধে্ব যে নারীর ব্যক্তিত্বশালিনী পরিচয় আছে, নারী যে পুরুষের কাছে দুর্লভ, পুরুষের একান্ত সাধনার ধন হতে পারে—এই কথাটিই রবীন্দ্রনাথ ‘অপরিচিতা’ গল্পে আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিলেন। আমাদের মস্তিষ্ককোষ তা কতটুকু ধরে রাখতে পারবে, সেইটেই ভাববার।
অতিরিক্ত পণের চাপে আজকাল ‘যৌতুক’ ও ‘পণ’ একাকার হয়ে গেছে। আজকাল যৌতুক বলতে আর শুধু মেয়ের বাবার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত উপহার দেয়াকেই বোঝায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বর পক্ষের বাধ্যবাধকতা।
এই গল্প লেখার ১১ বছর পরের আমরা আরো আধুনিক, আরো যুক্তিবাদী হয়েও মেয়ে বিয়ের বেলায় ছেলের বাবার কাংক্ষিত পণ-যৌতুকের কাছে জোড়হাত হয়ে দণ্ডায়মান হই অনুগত ভৃত্যের মত। ‘লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের বিয়ে হবে না- এই ভয়ে এখনও পাত্রপক্ষের অন্যায় আবদার আমরা মাথা পেতে নিই। সাহস করে প্রতিবাদ করি না, যদি আমার ঘরের মেয়েটিই লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যায়। পাত্রপক্ষের অপরিমিত দাবি মেটাতে না পারায় বা না মেটালে ঘরে ঘরে লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের সংখ্যা কতটা বাড়ে এবং পরবর্তীতে এদের সত্যি সত্যি অনুতা হয়ে থাকতে হয় কি না, আর থাকলেও তাদের জীবনটাও যে ব্যর্থ হয়ে যায় না, সেটা যাচাই করার পরীক্ষা করার সময় এসেছে। আমরা সম্ভবত সবাই চাই এই অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া প্রথার বিলোপ হোক। কিন্তু ঝুঁকি নিতে চাইনা কেউ। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে। মুসকিলটা এখানেই।
০৩.
ক্রীতদাস প্রথা সব ধনতান্ত্রিক দেশ থেকেই প্রায় উঠে গেছে। ক্রীতদাস প্রথার নামে আমরা আতঙ্কিত হই। অথচ একটু গভীরভাবে তলিয়ে ভাবলে পণপ্রথার ভয়াবহতাকে ক্রীতদাস প্রথা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলে ভাবা যায় না। উভয়ের উদ্দেশ্যই ব্যক্তিমর্যাদাকে ডুমুরিত করা। পার্থক্য এই পণপ্রথার শোষণটি রোমান্টিক — দাসীবৃত্তিত্বে তাই নিজেরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে যাই, আর ক্রীতদাস প্রথাটি মন ও শরীর উভয়দিক থেকেই নির্মম, তাই আতঙ্ক এতবেশি। পণপ্রথার মত ঘৃণ্য একটা প্রথা তাই আজও আমাদের সমাজে টিকে আছে। মেয়ের বাবার কাছ থেকে যে যত বেশি পণ নিতে পারেন, সেই পাত্র নিজকে ততবেশি যোগ্যপাত্র মনে করেন। একবারও কি তারা ভেবে দেখেন তাতে করে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, মানবিক মূল্যবোধ কোথায় উবে যায়! ভাবেন না। প্রতিটি ব্যক্তি একথা তলিয়ে ভাবেন না। ভাবলে পণপ্রথা বিরোধী আইন এ ভাবে ব্যর্থ হতো না। আইনত পণ দেয়া-নেয়া নিষিদ্ধ হলেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পণ দেয়া নেয়াটা দিনদিন জ্যামিতিক হারে এভাবে বেড়েই চলতো না। অতিরিক্ত পণের চাপে আজকাল ‘যৌতুক’ ও ‘পণ’ একাকার হয়ে গেছে। আজকাল যৌতুক বলতে আর শুধু মেয়ের বাবার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত উপহার দেয়াকেই বোঝায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে বর পক্ষের বাধ্যবাধকতা।
অথচ পণ আদান-প্রদাণের মত একটি ঘৃণ্য সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়া দরকার। প্রতিদিন যে হারে পণের দায়ে গৃহবধূর জীবন নাশ হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের নিজেদের কীর্তির চেয়ে অপকীর্তির দৃষ্টান্তই উজ্জ্বলতর হবে। ১৯৮৪-৮৬’র মার্চ পর্যন্ত পণের দায়ে বলি হয়েছেন ১৫৬২ জন নারী। ১৯৮০-৮৬-তে শুধু দিল্লীতেই পণের দায়ে মৃত্যু হয়েছে ২১৩৭ জনের। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এধরনের ঘটনায় গৃহবধূ-মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম।
১৯৬১ সালে সংসদে পণপ্রথা-বিরোধী আইন পাশ হয়। ১৯৮৪ সালে ঐ আইন সংশোধিত হয়। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট রাজ্যসভায় উত্থাপিত সংশোধিত পণপ্রথায় ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ‘পণপ্রথা সংক্রান্ত মৃত্যু’ নামে একটি নতুন অপরাধ যুক্ত করা হয়েছে। পণগ্রহণকারীদের পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই আইন কার্যে পরিণত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
কিন্তু দীর্ঘকালের অস্থিমজ্জায় চেপেবসা পণপ্রথার উচ্ছেদ ঘটানো শুধুই আইন করে সম্ভব নয়, এর হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে আনুষঙ্গিক আরো কিছু সমস্যার সমাধান দরকার।
ভারতবর্ষের অধিকাংশ মেয়েই কোনো না কোনোভাবে পিতা কিংবা স্বামী অথবা অন্য যেকোনো পুরুষের ওপর অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল। এই অর্থনৈতিক পরাধীনতা মানসিক মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে দেয়। ভরণপোষণ-দাতা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশের সকলের কথামত চলতে গিয়ে একসময় নিজের ইচ্ছেমত কথা বলতেই তারা ভুলে যায়। কোনো নারীকে স্বাধীনভাবে চলতে দেখলে অভ্যাসের বশে তাকে উচ্ছৃঙ্খল বলে মনে হয়। মনের ওপর বশ্যতা স্বীকারের এই পর্দাটি থাকে কিংবা না-থেকে উপায় নেই বলেই পুরুষদের হাতের পুতুল হয়ে তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। তাঁদের নির্যাতন সইতে হচ্ছে নিয়তির বিধান বলে অসহায়ভাবে মেনে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে হচ্ছে। আসলে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছাড়া নারীমুক্তি নেই, কোনো মতেই নয়। অক্ষমতা আর নির্ভরতা থেকে জন্ম হয় শোষণের বিভিন্ন কলাকৌশল। তাই পণপ্রথার ভয়াবহতা থেকে মেয়েদের রক্ষা করতে হলে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। একথা বলছি না যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এলেই পণপ্রথার ভয়াবহ পরিনাম সমূলে নিশ্চিহ্ন হবে, তবে অত্যাচার অনেকাংশে বন্ধ হবে, একথা নিশ্চিত। অত্যাচারীরা তাদের প্রাপ্তির স্বার্থেই অত্যাচার বন্ধ করবেন। আর যদি তাতেও অত্যাচার বন্ধ না হয়, তাহলে বিকল্প পথ খুঁজে নেবার সুযোগ মেয়েদের নিজের অধিকারে। কাজেই পণপ্রথার করুণ পরিণতিকে ঠেকাতে হলে চাই পুরুষের পাশাপাশি। নারীদের প্রায় সমস্ত ধরনের কাজে (যা তার শারীরিক দিক দিয়ে অসুবিধেজনক, কেবলমাত্র সে সব বাদে) অংশ গ্রহণের সমান অধিকার। একজন নিরক্ষর পুরুষের যদি কর্মসংস্থান হতে পারে, তাহলে একজন নিরক্ষর নারীর কর্মসংস্থান হতে পারবে না কেন? কাজ পাবার ব্যাপারে মেয়েরা, বিশেষত গ্রামের মেয়েরা, এখনও অনেক পিছিয়ে আছে, পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। কৃষক পরিবারের মেয়েদের এখনও স্বাভাবিকভাবে জমিতে কাজ করতে দেয়া হয় না। তাদের শারীরিক অক্ষমতাকে বড় করে দেখা হয়। অথচ এই শস্য উৎপাদন নারীর মৌলিক সৃষ্টি। জমির সব কাজই লাঙ্গল ঠেলার মত কঠিন নয়। সন্তানকে গর্ভে ধারণ ও লালন-পালনের মত কঠিন ধৈর্যের ও কষ্টের কাজটি যদি নারীদের দ্বারা অনায়াসে সম্পাদিত হতে পারে, তাহলে জননীতুল্য জমির সন্তানদের যত্ন নিতে নারীরা পারবে না, একথা কোন যুক্তিতে মেনে নিই? মেয়েরা জমিতে ফসল ফলানোর কাজে পুরুষদের সাহায্য করতে পারে না, কারণ তাতে পুরুষদের কর্তৃত্ব খর্ব হয়। এখানে কর্ম-নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় বাধা শোষণের আর একরকম প্রক্রিয়া। কয়লা-ভাঙা বা ইটভাঙা প্রভৃতির কাজেও মজুরী নির্ধারিত হয় স্ত্রী এবং পুরুষ হিসেবে আলাদা আলাদা ভাবে। কোনো মেয়ের কর্মক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে তাকে পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। যোগ্যতা শ্রেণীকরণের চাপে তলিয়ে যায়। এসব দিক ব্যাপকভাবে ভাববার দরকার। অবশ্য বলতে দ্বিধা নেই, সব মহিলাই কাজে নিযুক্ত হতে চান না। পুরুষের ওপর নির্ভর করে করে পরনির্ভরতাই কারো কারো কাছে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের ধারণা হয়েছে স্বামীদেবতার ঘাড়ে চেপে বসে খাওয়াটা যেন তাদের বৈবাহিক অধিকার। পরিশ্রমবিমুখ থেকে থেকে স্বনির্ভরতার কথা শুনলে ভেতরে ভেতরে তাঁরা আঁতকে উঠেন। এমন দৃষ্টান্তও সমাজে রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের মগজ ধোলাই- এর প্রয়োজন দেখা দেয়। অবশ্য সংখ্যার বিচারে এরা এতই নগন্য যে এদিকটাকে এক্ষেত্রে মুখ্য করে না ভাবলেও চলে।
এছাড়া, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এবং মহিলাদের শিক্ষার হার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। নিজেকে সচেতন করার জন্য শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথ দেখায় একথা বহুল প্রচলিত ।
বর্তমানে পুরুষ বেকার সমস্যার আধিক্য ‘পণপ্রথাকে বিলোপ করার পেছনে একটা বড় অন্তরায়। যেহেতু হাজার হাজার যুবকই এখন বেকার, তাই বিয়ের মাধ্যমে শ্বশুরের কাছ থেকে পণ নিয়ে তাদের অনেকেই চান ঐ টাকা দিয়ে ছোটোখাটো কিছু একটা কাজের ব্যবস্থা করে বেকারত্বের দুর্বিসহ জ্বালা ঘোঁচাতে, সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল হতে। এদিকটি ভাববারও প্রয়োজন আছে। সরকারী আইন করেও পণপ্রথার মত একটা ঘৃণ্য প্রথাকে বন্ধ করা যে যাচ্ছে না তার পেছনে ক্রমবর্ধমান যুব-বেকার সমস্যাও বেশ কিছুটা দায়ী।
সর্বস্তরের নারীসমাজকে পণপ্রথার কুফল সম্বন্ধে সচেতন করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমগুলিরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য প্রচার যদি একেবারেই প্রচারধর্মিতায় রূপ নেয়, (যেমন খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতিতে পরিবেশিত খবর বা তাত্ত্বিক আলোচনা) তাহলে তা সর্বসাধারণের মানসিকতাকে আলোড়িত না-ও করতে পারে।
রেডিও-টেলিভিশনে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, কিংবা নাটকাকারে যদি পণপ্রথার ভয়াবহতা, অধিকার সচেতনতাবোধ, স্বনির্ভরতার উপযোগিতা প্রভৃতি আরো বেশি করে হলে ধরা যায়, তাহলে কিছুটা সুফল পাবার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন সভাসমিতিও একাজে ভূমিকা নিতে পারে। পণপ্রথার করুণ পরিণতিকে ঠেকাতে হলে কন্যাদায়গ্রন্থ পিতাদেরও একটি ব্যাপারে সচেতন হওয়া বোধ হয় দরকার। সেটা হলো, বর ও কনে উভয় পরিবারের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং প্রতিপত্তিগত সমতাবিধান। কনের বাবা স্বভাবতই চান নিজের চেয়ে আরো বেশি স্বচ্ছল ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে। ফলে বরের ঘরের সঙ্গে নিজেকে ও মেয়েকে মানানসই করতে গিয়ে তাকে সামর্থ্যের বাইরে পাল্লা দিয়ে চলতে হয়; পাত্রপক্ষের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজেকে অন্যদিক থেকে ঋণের ভারে জর্জরিত করতে হয়। সে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে টিকতে না পারলেই পরিণতি হয় রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনার নিরুপমার মত। কাজেই কন্যাপক্ষকেও অবদমিতলোভের কামনাকে একটু সংযত করা ভাল নয় কি? তাতে করে মেয়ের পক্ষেও খানিকটা সুবিধে হয় স্বামী বা শ্বশুরের ঘরে নিজেকে মানিয়ে নিতে। আর একটা কথা। শুনতে কারো কারো কাছে শ্রুতিকটু হলেও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অবাঞ্ছিত নয়। তাহলো প্রাপ্তবয়স্ক পাত্র-পাত্রীকে তাদের মনমত স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনের সুযোগ দেয়া। যাকে সারা জীবনের জন্য সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়া হয়, তাকে উভয়ের ঐক্যমতের, চেনাজানার মধ্য দিয়ে, ভালবাসার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করাই কি ভাল নয়? মানছি এই চেনা-জানার মধ্যেও ফাঁক থাকে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবু নিজের মনের কাছে কিছু সান্ত্বনা থাকে। আর আমাদের যে মূল আলোচনার বিষয় পণপ্রথার ভয়াবহতা, তাকে অনেকাংশে হ্রাস করা যায়।
সবশেষে বলা যায়। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার কন্যা সম্প্রদান করতে গিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পেছনে তাঁদের নিজেদের বৈষম্যমূলক আচরণও কিছুটা পরোক্ষে দায়ী। পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যা সবার সমান অধিকার। একথা ভারতীয় সম্পত্তি অধিকার আইনেই স্বীকৃত। সম্পত্তির এই ‘সমানাধিকার আইন’-র দ্বারা স্বীকৃত হলেও সমাজের বিশেষত পিতাদের দ্বারা সহজ-স্বীকৃত বা সমবণ্টন হয়নি আজও। এখনও পিতারা স্থাবর সম্পত্তি ভাগ করেন ছেলেদের সংখ্যাগুণে। বণ্টনও করেন এভাবেই, যেমন দু’ছেলে হলে দু ভাগ, মেয়েকে সহজে হিসেবেই ধরতে চান না; ঐ মেয়ে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাভাবিক নিয়মে হতে পারছে না। আমাদের সমাজে তাই দেখা যায়, বাবার কাছ থেকেও একধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে মেয়েরা। নিজের আপন ঘর বলে কিছু থাকেনা এদের। ফলে অধিকাংশ নিম্ন-উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বিয়ের সময় বাবার অত্যধিক যৌতুক ও পণ দিতে দেখলে বিব্রত হন না, বরং মনে মনে খুশি হন এ ভেবে যে বিয়ের সময়ে যেটুকু পাওয়া গেল এটুকু যথার্থ পাওয়া, ওইটুকুই তার ভবিষ্যতের ভরসা। এর পরের পাওনা তো সব ফাঁকি। আর তাই বড় মেয়ের চেয়ে ছোট মেয়েকে কম দিলে ছোট মেয়ে মনে মনে চটে যায়। ভাবে কেন বরপক্ষ আর একটু চাইতে পারলো না। পাত্রপক্ষও বোঝেন, একবার ‘পণ’ নিয়েই সারাজীবনের জন্য মেয়েটির সমস্ত খরচ বহন করতে হবে, কাজেই যতটা সম্ভব চাপ দিয়ে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কাজেই মেয়েকে সুখী, স্বনির্ভর দেখতে হলে মেয়ের বাবাকেও বিমাতাসুলভ মনোভাব পাল্টাতে হবে, মেয়েকে দিতে হবে সুসম বণ্টনের আইনানুগ অধিকার।
পাদটীকা
১. রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ/আবুল কাশেম চৌধুরী সম্পাদিত, দেনা পাওনা, পৃ : ১৩।
২. ঐ। পৃ: ঐ।
৩. ঐ। পৃ: ঐ।
৪. ঐ। পৃ : ১৪
৫. ঐ পৃ: ১৫।
৬. ঐ। পৃ: ঐ।
৭. ঐ। পূ : ঐ।
৮. ঐ পৃ: ১৬।
৯. ঐ। পৃ: ১৬-১৭।
১০. ঐ। পৃ: ১৭।
১১. ঐ। পৃ: ১৮।
১২. ঐ। পৃ: ১৮।
১৩, হৈমন্তী, গল্পগুচ্ছ, দ্বিতীয় খণ্ড, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, আবুল কাশেম চৌধুরী সম্পাদিত, পৃ : ৬৪৮।
১৪. ঐ। পৃ: ৬৪৭।
১৫. ঐ। পৃ: ৬৫১।
১৬. ঐ। পৃ: ৬৫৭।
১৭. ঐ। পৃ : ঐ।
১৮. অপরিচিতা, গল্পগুচ্ছ, তৃতীয় খণ্ড, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, আবুল কাশেম চৌধুরী সম্পাদিত, পৃ : ৭০৭- ৭০৮।
১৯. ঐ। পৃ: ৭১২।
২০. ঐ। পৃ: ঐ।
২১. ঐ। পৃ : ঐ।
২২. ঐ পৃ : ঐ।