উপন্যাসে সমাজ জীবনের প্রতিফলন ঘটে। সমাজকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি পরিলক্ষিত হয়। একজন ঔপন্যাসিক সমাজ থেকে উপকরণ গ্রহণ করে কল্পনার আশ্রয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেন তাই বলা যায়, উপন্যাস সমাজ বাস্তবতা এবং কল্পনার সংমিশ্রণে সৃষ্টি। সমাজ তথা পারিপার্শ্বিক জগত ব্যতীত শুধু অলীক কল্পনার ফলে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠতে পারে না।
উপন্যাস একদিকে যেমন ব্যক্তি মানসিকতার প্রতিফলন তেমনি এখানে সমাজ মানসিকতার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। সৃষ্টির দিক থেকে আধুনিক উপন্যাস ব্যক্তি-প্রতিভার দান এবং প্রতিপাদ্যের দিক থেকে সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছায়া। ফলে ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনের অন্তরঙ্গেও বহিরঙ্গে চিন্তাস্রোত, ঘটনাপ্রবাহ ও যুগাবর্ত লক্ষ্য করা যায়। এক কথায় বলা যায় উপন্যাসের রূপায়িত জীবন ব্যক্তিমানুষ ও সামাজিক মানুষের জীবন ধারার অনুবর্তী। দিলারা হাশেমের উপন্যাস সময়জ্ঞান, সমাজজ্ঞান ও ইতিহাসজ্ঞানের ভিত্তিতে রচিত। তার উপন্যাস সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, হতাশা-নৈরাশ্য, বিকৃত-বৈকল্য, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব প্রভৃতি স্থান পেয়েছে। কিন্তু তাঁর উপন্যাসের মূল প্রবণতা লক্ষ করি-মধ্যবিত্তের সংকট এবং নারীকে কেন্দ্র করে। সামাজিক ইতিহাসের দলিল স্বরূপ বলা হয় উপন্যাসকে।
উপন্যাসে মুখ্য এবং গৌণ কিছু বিষয় থাকে ফলে উপন্যাসে কখনো কখনো সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব প্রধানরূপে প্রতিফলিত হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাসেই সমাজের চিত্র বিশেষভাবে ধরা পড়ে। উপন্যাসের উপকরণ লেখক সমাজ থেকে গ্রহণ করেন এ কারণে উপন্যাস বাস্তবমুখী শিল্পমাধ্যম। দিলারা হাশেমের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক সংকটকে বাস্তবমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে রূপায়িত করা হয়েছে। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ (১৯৬৫)-তে মধ্যবিত্ত জীবনের নানাবিধ সংকট লক্ষ্য করা যায়।
উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র নাজমা। বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রে নাজমার অবস্থান, তাকে ঘিরেই উপন্যাসের পট উন্মোচিত হয়েছে। নাজমার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করত কিন্তু হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পরিবারে আর কোন ছেলে সদস্য না থাকায় এবং নাজমা বড় মেয়ে হওয়ায় সংসারের সকল দায়ভার তার ওপর বর্তায়। নাজমা চরিত্রটিকে ঔপন্যাসিক আর দশটা বাঙালী মধ্যবিত্ত নারীর রূপে চিত্রায়িত করেছেন।
নাজমার মধ্যে লেখক মধ্যবিত্তের টানা-পোড়েন, সম্মান-অসম্মান বোধ, সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। সে চাইলেই তার প্রণয়ী ভালোবাসার মানুষ মালেকের সঙ্গে এক রিক্সায় করে বাজার করতে যেতে পারে না। সমাজের রক্তচক্ষু তার মধ্যে দ্বৈতসত্তার সৃষ্টি করে। একবার তার মনে হয় তার যে অবস্থা সেখানে এই সস্তা আবেগের কোন দাম নেই। নাজমা চরিত্রের মধ্যে আমরা দ্বন্দ্বমথিত চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই, ‘… দূর ছাই, কি সব বাজে সেন্টিমেন্টের জন্য একটি পুরো টাকাই বেরিয়ে গেল রিক্সায় ভাড়া। গরিবের ঘোড়া রোগ সাজে না। ও চড়বে একশ বার চড়বে এক রিকশায়।’ নাজমা চরিত্রের পাশাপাশি ঔপন্যাসিক আরেকটি চরিত্রকে উপন্যাসে প্রায় সমান গুরুত্ব সহকারে চিত্রিত করেছেন। নাজমার বোন আসমা। উঠতি যৌবন প্রাপ্ত। পাশের বাড়ির বান্ধবী নাসরিনের ভাই আখতারের প্রলোভনে পড়ে শরীরী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আসমা সবে ম্যাট্রিক টেস্ট দিয়েছে আর আখতার বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলে। মা মারা যাবার তিন মাস পরেই তার বাবা যখন তারই বন্ধুর মাকে বিয়ে করে বসে তখন থেকে সব গুরুতর ব্যাপারকে সহজ করে দেখবার পাট নিয়েছে সে। তারা দুই ভাই-বোন ফুপুর কাছে থাকে।
আখতারের বেপরোয়াভাবে বেড়ে ওঠার পিছনে মায়ের মারা যাওয়া, বন্ধুর মাকে বাবার বিয়ে করা ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক বিষয় বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। তাই জীবনের কোন কিছুই সিরিয়াসলি নিতে শিখেনি সে। আসমার সঙ্গে ভালবাসার ছলনা করে সে শুধু তার আদিম ক্ষুধা তৃষ্ণার নিবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল। অন্যদিকে আসমা অনেকটা কৌতূহলবশত সর্বোপরি তার সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মন খানিক উৎসুক হয়েই ধীরে ধীরে আখতারের কোপানলে পড়ে। আসমা নিজের মনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সে জানে আখতারকে সে ভালোবাসে না আবার এড়িয়ে যেতেও পারে না।
মায়ের ভালোবাসা সর্বদাই কালজয়ী। সন্তান যেমনই হোক মায়ের থেকে তার বিচ্ছেদ ঘটানো যায় না।
আসমা চরিত্র নির্মাণে ঔপন্যাসিকের সূক্ষ্ম মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আসমা একান্তভাবে যা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল সে নিজেই তা ঘটায়। তার মনের গতি উঁচু থেকে গড়িয়ে নেমে আসা একখ- পাথরের গতির মতো। সে কিছুতেই রুখতে পারে না নিজেকে। এখানে ঔপন্যাসিক ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন। লেখক তার মনের গতিবিধকে উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন এভাবে, ‘আখতারকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে তোমাকে ভালবেসেছি একথা কবে আমি বলেছি? কিন্তু আখতারের দিকে চেয়ে একথা সে বলতে পারল না। মায়া জাগানো এক দুর্বলতা এলো নিজের মধ্যে। আখতারকে ভালো লাগতে লাগল। মনে হলে বুঝিবা ভালোবাসেও।’
আখতার ও আসমার সম্পর্ককে ঘিরে তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করে সে। আসমা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা আসমাকে রেখে সব বাধা উপেক্ষা করে আখতার করাচি চলে যায়। আসমার গর্ভের সন্তান সমাজ স্বীকৃত না হওয়ায় তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। আসমার প্রাণ রক্ষার্থে নাজমাকে আত্মবলিদান করতে হয়। সে নিজের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে মালেককে বাধ্য করে আসমাকে বিয়ে করতে, ‘তুমি চিরদিন আমাদের অনেক সাহায্য করেছো। আসমাকে বিয়ে করলে জেনো, আমাদের সবচেয়ে বড় উপকার করা হবে। ও ছেলেমানুষ, না বুঝে, প্রলোভনে পড়ে হয়ত একটা ভুল করে ফেলেছে, সে ভুলকে একমাত্র তুমিই পারবে শুধরে নিতে।’
আসমা, নাজমা, মালেকের জীবনসংগ্রাম কঠোর থেকে কঠোরতর পর্যায়ে পৌঁছে। মালেককে নাজমা খুব ভালবাসে। মালেকের সঙ্গে ঘর বাধার স্বপ্ন তার মানে ধীরে ধীরে বিশালতা পেয়েছিল কিন্তু সবকিছু এক নিমেষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় আসমাকে কেন্দ্র করে। নাজমা কিছুই ভাবতে পারে না। মালেক যখন অভিমানের বশে আসমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় তখন নাজমার মনের দ্বৈতসত্তা তাকে দুমড়ে মুষড়ে দেয়। তার বার বার মনে হয় আসমার ভুলের মাশুল আসমা দেবে। আসমার জন্য কেন পৃথিবীকে বিবর্ণ করে দেখতে হবে তাকে। মালেককে কিছুতেই হারাতে পারবে না সে।
নাজমার ওপর অভিমান করে মালেক আসমাকে ঠিকই বিয়ে করে কিন্তু বিয়ের রাতেই মালেক আসমাকে চিঠি লিখে নিরুদ্দেশ হয়। এ পর্যায়ে উপন্যাসের ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত হয়। আসমা আখতারের সন্তানকে মালেকের পরিচয়ে পরিচিত করে। সমাজের চোখে আসমার এই সন্তান যতই অবৈধ বা জারজ সন্তান রূপে অভিহিত হোক মায়ের কাছে সন্তান পরম পাওয়া এবং আদরের। তাইতো আসমা নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়ে হলেও বুকের সন্তানকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে।
ঔপন্যাসিক মাতৃত্বের কাছে সবকিছুর পরাজয় দেখিয়েছেন এভাবে, ‘ওকে কোলে উঠিয়ে বুকে চেপে ধরে আসমা। সমস্ত তিক্ততা বেদনা, শূন্যতা যেন ফুলের মতো নিষ্পাপ এক কোমল অনুভূতির তলায় ডুবে যায়। নিজের রুগ্ন হাতের পাঁচটি আঙুলের ছাপ যেখানে রাতুলের ফর্সা গালে লাল হয়ে ফুটে উঠেছে সেখানে অজস্র চুমোয় ছুয়ে দিতে দিতে আসমা বলতে থাকে আজ আমার সোনামণির জন্মদিন।’ মায়ের ভালোবাসা সর্বদাই কালজয়ী। সন্তান যেমনই হোক মায়ের থেকে তার বিচ্ছেদ ঘটানো যায় না।
অধিকাংশ সময় তারা দোদুল্যমানতায় ভোগে। কোনটা সঠিক আর কোনটা আদৌ ঠিক নয় সেই দিক নির্দেশ করতে গিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
প্রাচীন সাহিত্য থেকে বর্তমান সাহিত্য অবধি পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠতম ভালবাসার অবক্ষয় ঘটেনি। মায়ের ভালবাসা জগৎ শ্রেষ্ঠ তা যেমন বাস্তব সত্য তেমনি সাহিত্য সত্য। আসমা নিজের সর্বস্ব পথের ধূলোয় লুটিয়ে দিয়ে কোলের সন্তানকে পৃথিবীর নতুন সূর্যের আলো দেখাতে চেয়েছে। জীবনসংগ্রামে পরাজয় বরণ করে আসমা একসময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে যায়। আসমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করায় নাজমাকে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। স্ত্রী নিশাত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত জব্বার সাহেবের সঙ্গে বিয়ে করার কথা ঘোষণা করেছিল নাজমা। কিন্তু নাজমার মনে মালেকের প্রতি অগাধ ভালবাসা লক্ষ করে জব্বার সাহেব বিয়ের দু’দিন আগে বিদেশে চলে যায়। পদে পদে জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে নাজমা এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
আসমার মৃতদেহের পাশে বসে নাজমা অজস্র কান্নায় ভেঙে পড়ে। ঔপন্যাসিক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘শিথিল হয়ে গেছে আসমার শরীর, সকলের ডাক উপেক্ষা করে, জীবনের সঙ্গে ঋণ চুকিয়ে আসমা চলে গেছে সমস্ত বেদনার উর্ধ্বে।…বিছানার পার্শ্বে অজস্র কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে নাজমার দেহ। নাজমা আজ কাঁদুক…আজ আর অভিনয় নয়।’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তুঙ্গা। ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেম তুঙ্গা চরিত্র নির্মাণের মধ্যে দিয়ে সমাজ বাস্তবতাকে বিশেষভাবে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন।
আমাদের সমাজে একটা পুরুষ নিজের প্রয়োজন যে কোন কাজ করতে পারে তাকে কেউ বাধা প্রদান করে না কিন্তু একজন নারী নিজের সম্মান বাঁচিয়ে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেও সমাজের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন হয়। তুঙ্গা গতর খেটে উপার্জন করে নিজের জীবনজীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু সমাজের ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে যে পশুরূপী মানুষ আছে তারা তুঙ্গার মতো একাকী মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দিতে নারাজ।
পশুগুলো রোজ রাতে দুয়ারে ধারণা দিয়ে কুকথা বলে তাই তুঙ্গাকে প্রায় রাতেই জেগে কাটাতে হয়। তুঙ্গার জীবন সংগ্রামের চিত্র উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে লেখক সমাজের অন্ধকার দিকের প্রতি নির্দেশ করেছেন। উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী অথবা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ্য করি তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করে না। তাদের মনের গতি তাদের যেদিকে নিয়ে যায় তারা সেদিকেই পথ সৃষ্টি করে কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা সর্বদা তাদের বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে চেষ্টা করে। তাদের মধ্যেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বেশি। অধিকাংশ সময় তারা দোদুল্যমানতায় ভোগে। কোনটা সঠিক আর কোনটা আদৌ ঠিক নয় সেই দিক নির্দেশ করতে গিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।