আজ দিনটা বড় ম্যাজম্যাজে। কিছুকিছু দিন আকাশ এমন কালো হয়ে থাকে যে দেখলে নিজেরও মুখ কালো হয়ে যায়,মন উদাস হয়ে যায়। আর যাদের পুরোনো জিনিসের প্রতি টান, সেইসব জিনিসের চৌম্বকত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
সুরমার আজ ছুটি। পরিবার বলতে তো স্বামী, ছেলে আর সে। অনিন্দ্য আজ অফিসের কাজে দুদিনের জন্য কালিম্পং গেছে আর ছেলেরও স্কুল ছুটি। সে আগেই অনুমতি নিয়ে নিয়েছে মায়ের কাছ থেকে, যে আজ সে ঘুমোবে। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোবে, এমনকি উঠতে না ইচ্ছা করলেও সে ঘুমোবে। তাকে যেন ডাকা না হয়।
সুরমারও আজ ওই উদাস মেঘের মতো অবস্থা। কিছুটা রোজকার ঝক্কির ক্লান্তিতে, আর বাকিটা ঝক্কি-মুক্তির শান্তিতে। সে-ও অনুমতি দিয়ে দিয়েছে ছেলেকে। একবার অবশ্য ডেকেছিল জলখাবার টা খাওয়ার জন্য। তা কে আর শোনে।ঘুমের ঘোরে একবার শুধু বললো, “পরে খাবো”, তারপর আবার ঘুম…
সুরমা রান্না বান্না সেরে জানলার ধারে একটু দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ যা করেছে,দেখে মনে হচ্ছে এই কি সেই বুঝি বৃষ্টি নামলো বলে…
সুরমার ঢেউ খেলানো চুল কোমর পর্যন্ত খোলা। দুই ভ্রুর মাঝখানে সিঁদুরের গোল লাল টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর। খুব সাধারণ একটা ধনেখালী ডুরোকাটা খয়েরি শাড়ি পরে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে…
সকালের জলখাবার সেই কখন হয়ে গেছে। বাবুটা তো উঠছেই না ঘুম থেকে। আজ দুপুরের জন্য শুধু মুরগির ঝোল আর ভাত। সেটাও কমপ্লিট। এখন সে গরাদের ভেতর থেকে বাইরেটা দেখছে। মন দিয়ে।
সুরমা কিছুই বুঝতে পারছে না এসব কি বলছে অনিতা দি। সে কখন ও বাড়িতে গেলো, পড়লোই বা কি করে…
সুরমাদের বাড়িটা উত্তর কলকাতায়, কলুটোলা স্ট্রিট এ। বাড়ির পেছনে বেশ কিছুটা জায়গা খালি। বড় বড় গাছপালা আর আগাছার জঙ্গল হয়ে রয়েছে। পুরোনো ভাঙা শ্যাওলা মাখা একটা বিশাল পাঁচিলের অবশেষ আর ওই ভাঙা বাড়িটা। যে বাড়িটা নাকি আগে কোনো জমিদার বাড়ি ছিল। এই এলাকার কোনো এক অত্যন্ত ধনী এবং অভিজাত জমিদার বাড়ি। সুরমাদের বাড়িটা এখন যেখানে, সেই সব জায়গাই ওই জমিদারদের ছিল। শুধু ওদের কেন, ওদের আশেপাশের সমস্ত বাড়িই এখন ওই জমিতেই, যেখানে আগে হয়তো ওই জমিদার বাড়ির এই মহল সেই মহল ছিল। এখন সব বিক্রি হয়ে বুজে, শুধু একফালি জমি পড়ে আছে, যেটা এখন একটা পাঁচিল আর কিছু আগাছা তে মোড়া। আগে নাকি এখানে একটা পুকুর ছিল, মাছ চাষ হতো সেখানে, এখন শুধু মশার চাষ হয়। সন্ধ্যেবেলা জানলা খোলা রাখা দায় হয় মশার উৎপাতে।।
কিন্তু ওই ভাঙা অবশিষ্ট বাড়িটা সুরমাকে বরাবরই কেমন যেন উদাস করে দেয়। তার অনেকবার মনে হয়েছে অনিন্দ্য কে বলে, যে একবার গিয়ে দেখে আসবে বাড়িটা। একবার ইনিয়ে বিনিয়ে বাড়িটার কথা তুলেওছিলো। অনিন্দ্য হেসেই উড়িয়ে দিলো। বলল ডেঙ্গু সিজন আসুক, তোমাকে নিয়ে যাবো খন।।
আজ তার বড্ড ইচ্ছা করছে একবার গিয়ে ঘুরে দেখে আসে জায়গাটা। বাড়িটার ভেতরে এখনো নাকি একটা ভাঙা নাটমঞ্চ রয়েছে, কয়েকটা ভাঙা থাম আর কিছু ভাঙা কাঁচের টুকরো। ওই নাটমঞ্চেই নাকি একসময় বহু নামকরা শিল্পীদের আগমন ঘটতো বিভিন্ন যাত্রাপালা আর থেটার দেখতে…
সুরমা যেন দেখতে পায়, এখনো ওখানে কোনো থেটার হচ্ছে, গমগম করছে লোক। ধুতি পাঞ্জাবি পরে মখমলের সরু চাদর কাঁধের একপাশে থেকে সরু ভাঁজে নিয়ে বসে আছেন রাশভারী কোনো জমিদার। কুচকুচে কালো গোঁফ, তা দেওয়া। হাতে রুপোর কাজ করা হাতির দাঁতের বাঁধানো লাঠি। একটু দূরে দোতলায় পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি অন্তঃপুরবাসিনী। তাদের উৎসাহের অন্ত নেই। আজ বাড়িতে থেটার হবে। ম্যাকেনজি সাহেব আসবেন থেটার দেখতে। বাড়িতে তাই সাজো সাজো রব। বাচ্চারা ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। বাড়ির চাকর বাকরদের বেজায় ব্যস্ততা। ভেতরে ভিয়েন বসেছে। গাওয়া ঘি আর রসের গন্ধে ম ম করছে সারা বাড়ি…
সুরমা নিজেও খেয়াল করেনি যে সে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে ওই নাটমঞ্চটা-তেই…আর এই দৃশ্যগুলো যেন তার চোখের সামনে সে দেখতে পাচ্ছে… তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে…
ঐতো রায়বাহাদুর মশাই সবাইকে আপ্যায়ন করছেন, গিন্নিমা পর্দার আড়ালে থেকে বাড়ির সকল ছোটদের বকাবকি করছেন অত জোরে হাসাহাসি করার জন্য, বিনোদিনীকে এক ধমক দিলেন এখনো সে না সেজে বসে আছে। চুল খোলা, সামান্য একটা সাধারণ শাড়ি পরে সে খেলা করছে কুসুমবিলাসি আর কুমোদিনীর সাথে। গায়ে কোনো গয়না নেই, চোখে নেই কাজল, ধিঙ্গি মেয়ের মতো নেচে বেড়াচ্ছে। মায়ের বকা শুনে তড়িঘড়ি দৌড় লাগালো সে ঘরের দিকে।
সুরমা ডাক দিল “বিনু, বিনু… আমি আমি সুরো, এদিকে তাকা, বিনু দেখ”…
বিনু কিছু দেখতেই পেলো না, ঘরে ঢুকে গেলো… সুরমা দৌড়াতে গিয়ে এক হোঁচট খেলো আর লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে…
কতক্ষন ওইভাবে ছিল সে জানেনা। চোখ যখন খুললো, তখন সে তার বেডরুমে। বাবু অঝোরে কেঁদে চলেছে, আর ডাক্তার তার নাড়ি পরীক্ষা করছেন। পাশের বাড়ির নটি কাকা, সত্যেন দা, অনিতা দি আর অনন্যাও আছে। অনিতা দি বললেন, “ঐতো জ্ঞান ফিরেছে। সুরমা চোখ খুলেছে’…
কিরে সুরমা, ওই ভাঙা বাড়িটায় কি করতে গেছিলিস। পা পিছলে পড়েছিলিস বোধয়। চারিদিকে শ্যাওলা, ওই জায়গায় কেউ যায়। তোর কি আক্কেল নেই রে…
ভাগ্যিস তোর মেসোমশাই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তোর চিৎকার শুনে ছুটে গেলেন।
সুরমা কিছুই বুঝতে পারছে না এসব কি বলছে অনিতা দি। সে কখন ও বাড়িতে গেলো, পড়লোই বা কি করে…
সে কোনোরকম উঠে বাবুকে বুকে জড়িয়ে বললো, “খেয়েছিস কিছু বাবু?”