বর্তমান জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনরা যে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্কে মেতে থাকেন সেখানে তারা কথা বলার সময় একে অপরকে দেখতে পাননা। এতে একটি শব্দ, বাক্য ব্যবহারে তাদের মুখে ফুটে উঠা যে অভিব্যক্তি কিংবা কণ্ঠে ব্যবহৃত স্বর দেখা কিংবা শোনা যায়না। এতে একে অপরের সঙ্গে মতানৈক্য ব্যতিরেকেও বিভেদ তৈরি হয়। এই বিভেদ একটা অবস্থান তৈরি করে এবং সে অবস্থানের ভিত্তিতে একে অপরকে বিচার করে থাকে। এজন্য ব্যক্তির অভিব্যক্তি বোঝার ক্ষেত্রে সামনাসামনি কথা বলার গুরুত্ব অনেক।
সাহিত্যের অন্য যেকোনো শাখার চেয়ে নাটক মানুষকে দ্রুত কাছে আনে। যেমনটি উপস্থাপন করা হয় তেমনটিই বুঝতে সহায়তা করে। আমরা যদি ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসের কথা বলি তাহলে এটি পড়ে পাঠকের মধ্যে যে অনুভূতি সঞ্চারিত হয় সত্যজিৎ রায়ের বানানো সিনেমা তা দেয়না বরং আলাদা ইমেজ তৈরি করে। উপন্যাসকে অডিও ভিজ্যুয়ালের উপযোগ তৈরি করতে হয়েছে, আর নাটক যথা টিনের তলোয়ার, মঞ্চায়নের জন্য লেখা বা নির্মাণ করা করেছে। মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে যেসব নাটক লেখা হয় তার ক্ষেত্রে ভিন্ন প্রভাব কাজ করে। এখানে সংলাপ ও চরিত্র সমভাবে একটি বিষয়বস্তুকে দাঁড় করাতে সাহায্য করে।
সারাবিশ্বেই ব্যবসায়ী, শিল্পবোধহীন রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা চালানোর উদ্দ্যেশে বিত্তশালীর কাছে শিল্পীরা মানসিক পরাজয় স্বীকার করে চলেছেন।
নাটক যেহেতু একটি ‘পারফর্মিং আর্ট’ সেহেতু চরিত্রের অঙ্গভঙ্গি ছাড়াও তার সংলাপই দর্শককে সামনের সারিতে বসিয়ে রাখে। উৎপল দত্ত নিজেকে প্রোপাগান্ডিস্ট বলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক নাটক এক্ষেত্রে বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়াতে পারে। মতাদর্শ গড়ে তোলার পাশাপাশি উৎপল দত্তের নাটক প্রতিবাদধর্মী। সমসাময়িক যেকোনো বিষয় রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপান্তর ঘটিয়ে নাটকে উপস্থাপন করা তাঁর বড় কৃতিত্ব। এছাড়া উৎপল দত্তের ক্ষমতা ছিলো নাটককে বহুদিক দিয়ে ঘুরিয়ে এনে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করানোর। সমাজের কালচারাল ও সোস্যাল জায়গায় উৎপল দত্ত এমন কাউকেই ছাড় দেননি যাকে সমালোচনা করা যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে সময় ব্যাপারটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যেমন অর্থনৈতিক দারিদ্র্য তৈরি হয়েছিলো এরচেয়ে বেশি দারিদ্র্য ছিলো ভাষা, সংস্কৃতি ও মনন গড়ে উঠার ক্ষেত্রে। চিন্তার দীনতাকে শুধু উপনিবেশায়নের ফল হিসেবে দেখা যায়না।
বাস্তব পরিস্থিতি দেখে সত্য বলার সাহস, যোগ্যতার উদাহরণ কম ছিলো। উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার ‘নাটকের প্রেক্ষিত ১৮৭৬ সালের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন হলেও এখানে আছে ইংরেজদের অত্যাচারের কথা, নীলদর্পণ নাটকের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, সাধারণ একজন মেয়ের অসাধারণ অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠার চমৎকার ঘটনা। নাটকের প্রাণ হচ্ছে সংলাপ। টিনের তলোয়ার যেহেতু মঞ্চনাটক সেহেতু এ নাটকের সংলাপ উচ্চরবে উচ্চারিত। কখনো এতে যাত্রার ঢংও আছে। টিনের তলোয়ার উৎপল দত্ত রাজনৈতিক নাটক। রাজনৈতিক মঞ্চ নাটকে যাত্রার ঢং থাকাও আরেকটি নাট্যিক সংযোজন। তবে উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকগুলোর অধিকাংশই সংলাপপ্রধান। বিষয় অনুসারে সংলাপের বাহার বা আতিশয্য ছাড়া তা
লেখাও সম্ভব ছিল না। টিনের তলোয়ারের অধিকাংশ চরিত্রই সাবল্টার্ন। নাটকের শুরুতে আমরা দেখবো মেথর বেণীমাধব বাবু যিনি গ্রেট বেঙ্গল অপেরার প্রধান তার গায়ে ময়লা ঢেলে দিচ্ছে। মেথরের সঙ্গে তার আলাপ হচ্ছে। তিনি মেথরকে নাটক দেখার আহবান জানাচ্ছেন। এ আহবান সত্যিকারের আহবান। ধারণা দেওয়া শুরু করেন। গণমানুষের জন্য নাটক লেখা শুরু করেন। গণমানুষ এতে অংশ গ্রহণ করুক এটি তিনি চেয়েছিলেন। সহজ ভাষা ও শব্দের ব্যবহার মানুষকে মানুষের কাছে আনে।
বেণিমাধব যখন মাইকেল মধুসূদনের কাব্য পড়ে শোনাচ্ছেন এবং মেথরের অভিব্যক্তি জানতে চাচ্ছেন কাব্য হিসেবে তা কেমন তখন মেথর বলছে, ‘জঘন্য! ‘ অবশ্যই উৎপল দত্ত মেথরকে দিয়ে তা বলিয়ে নিয়েছেন। ভাষার জটিলতা মানুষকে মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ন্যায়বিচার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়না। আমরা টিনের তলোয়ারের নায়িকা ময়নাকে মঞ্চে প্রবেশ করতে দেখবো তার ভাষাসহই। সে যখন বেণিমাধবকে খুঁজতে এসেছে তাকে মঞ্চে অভিনয়ের সুযোগ পাবে বলে তখন থিয়েটারের অন্যসদস্য তাকে পাওনাদার মনে করে পয়সা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইলে সে বলছে, ” তোর মাগকে পয়সা খাওয়াস (পয়সা ছোঁড়ে), শালা বেল্লিক কোথাকার। কাপ্তেনবাবু শালা মিথ্যেবাদী। আমাকে বললে, থেটারে রাণী করে দেবে। আর এখন হাকিয়ে দিচ্ছে দেখ!” ময়নার মুখের ভাষা তথা সংলাপই প্রমাণ করছে সে নিম্নবর্গ।
উৎপল দত্ত যে গণনাট্যসংঘ গড়ে তোলতে চেয়েছিলেন সেখানে শুধু গণের জন্যই নাটক লেখা হবেনা বরং গণের বিরাট অংশ সেখানে এসে অভিনয়ও করবে। তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে ময়নার এই সংলাপ শুধু আক্রোশ প্রকাশ করে তাই নয় সমাজের উঠতি ধণিক/ বণিকশ্রেণির অপসংস্কৃতিকে তুলে ধরে যেখানে তারা স্ত্রী ব্যতিত রক্ষিতা রাখার প্রচলন ছিলো। উল্লেখযোগ্যহারে নিম্নবর্গের সুন্দরী মেয়েরা এর শিকার হতো। আমরা ময়নার বাকি সংলাপ থেকে দেখবো পুরুষেরা নারী সেজে অভিনয় ছাড়ার পর থিয়েটারে যখন প্রথম মেয়েরা আসতে শুরু করে তখন তারা অধিকাংশই এসেছিলো দেহবৃত্তি ছেড়ে নয়তো একেবারে নিম্নবর্গ থেকে। এদেরকে বণিকশ্রেণির অন্দরমহলেও ব্যবহার করা হতো। বিনয় ঘোষের ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা বইয়ে ডয়িলি অংকিত ধনিকগৃহে আমন্ত্রিত সাহেবদের আপ্যায়নে বাইজী নৃত্যের ছবি দেখা যায়।
টিনের তলোয়ার নাটকে আমর ময়নাকেও ধনী বণিকের গৃহে রক্ষিতা হতে দেখি। উৎপল দত্ত এই নাটকের এসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন শুধু ময়নার একটি সংলাপের মধ্য দিয়েই। অডিও ভিজ্যুয়াল যুগের বাড়বাড়ন্তির আগ পর্যন্ত নাটক সবচেয়ে সক্রিয় ও শক্তিশালী আর্ট হিসেবেই প্রশ্নাতীত ক্রিয়াশীল ছিলো। নাটকের মঞ্চায়নে নাট্যকারকে বিষয়ের উপর যেমন গুরুত্ব দিতে হয় তেমনি এর সংলাপের দিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হয়। নাটকের সংলাপ এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা কখনো শুধু একটিমাত্র সংলাপ দিয়ে একটি নাটককে চিনতে পারি। যেমন উপায় নাই গোলাম হোসেন’ বললে আমরা সিরাজদ্দৌলা নাটককে সামনে আনি কিংবা ‘ব্রুটাস তুমিও!’ বললে জুলিয়াস সিজার নাটকটি আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। টিনের তলোয়ার একটি প্রতীকী নাটক, প্রতিবাদী নাটক। ইতোপূর্বে চলে আসা নাটকের
কন্টেন্টের জায়গায় নয় শুধু উপস্থাপনভঙ্গিতেও অন্যান্য নাট্যকারদের নাটককে এটি ছাড়িয়ে গেছে। ‘নাটকের ভেতরে নাটক’ দেখানো বাংলা নাটকে সম্ভবত উৎপল দত্তই প্রথম সফলভাবে দেখিয়েছেন।
একটি নাট্যদল নানারকম নাটক করার উদ্যোগ নিচ্ছে। আবার তাদের নিজেদের মালিকানায় কোন নাট্যদল নেই। কোনো এক বেনিয়া সুদখোর মুৎসুদ্দি তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সেখানে তার পছন্দমতো নাটক পরিবেশন করতে নাট্যদলকে নাটকের পাঠ মুখস্থ করতে হচ্ছে। নাটক করে যারা সমাজ সংস্কৃতি জীবন ও দেশকে পরিবর্তন করে ফেলতে চান তাদেরকেই নতজানু হতে হয় ব্যবসায়ীর কাছে। মূলত, সারাবিশ্বেই ব্যবসায়ী, শিল্পবোধহীন রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা চালানোর উদ্দ্যেশে বিত্তশালীর কাছে শিল্পীরা মানসিক পরাজয় স্বীকার করে চলেছেন। তবে থিয়েটার সবসময় মানুষকে নতুন বার্তা দেয়। নতুন কনসেপ্টকে প্রয়োগ করে দেখায়।
অসাধারণ সংলাপগুণ ও পরিবেশন দক্ষতায় টিনের তলোয়ার নাটকটি বাংলা নাটককে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।
নতুন দর্শনও থিয়েটায়ের চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। থিয়েটারে অভিনয় করার পূর্বের মানুষ ও পরের মানুষে একটা পার্থক্য সূচিত হয়। পরিমিতিবোধ, পরিশীলন ও পরিচর্যা থিয়েটারের প্রাণকথা। আমরা দেখবো বেলিমাধব যে ময়নাকে আস্তাকুঁড়ে থেকে নিয়ে আসলেন থিয়েটারে রাণী করে দেবেন বলে রাণী সে না হলেও যে মানুষে পরিবর্তিত হলো তা এক ভিন্ন ময়না,ভিন্ন মানুষ যে অবশেষে নিজেকে বিক্রি করে দিয়ে বলতে পারলো ‘পারবো না, থিয়েটার ছাড়া আমি বাঁচবো না।’
উৎপল দত্ত এখানে প্রকৃত থিয়েটার করা স্বপ্নবাজ মানুষের কথা বলেছেন। যে মানুষ মানুষের মুক্তির কথা বলে। ময়না বীরকৃষ্ণের রক্ষিতা হয়ে নিজেকে জলাঞ্জলি দিলো শুধু মঞ্চে অভিনয় করতে পারবে এই প্রতিশ্রুতি পাবার ফলে। ময়না যখন বীরকৃষ্ণের দেওয়া ব্রেসলেট পরছে তখন আগামী নাটকের জন্য মুখস্থ করা সংলাপগুলো বলছে এভাবে- “কহিলা বীরেন্দ্র বলী” ( বাহু বাড়িয়ে দেয়, বীর ব্রেসলেট পরাচ্ছেন) ” ধর্মপথগামী হে রাক্ষসরাজ বিখ্যাত জগতে তুমি। কোন ধর্মমতে, কহ দাসে শুনি, জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি সকলি দিলা জলাঞ্জলি? ” উৎপল দত্ত এখানে ‘মেঘনাথবধ’ কাব্য থেকে উচ্চারণ করছেন।
মাইকেল মধুসূদনকে তিনি জঘন্যও বলাতে পারেন আবার গ্রহণও করতে পারেন প্রয়োজন অনুযায়ী। মেঘনাথ বিভীষণকে যে প্রশ্ন করেছেন লঙ্কায় রামকে প্রবেশ করতে সহযোগিতা করেছেন বলে সে প্রশ্ন একইভাবে ময়নাও কি করছেনা বেণিমা ধমকে? উৎপল দত্ত চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন ন্যায় প্রশ্নে এই সংলাপ ব্যবহার করে। বেণিমাধব ‘তিতুমীর’ নাটক করার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনেতা অভিনেত্রীদের পুলিশে ধরে নেয়। দেশদ্রোহী নাটক করার জন্য জেল হয় সবার। বেলিমাধব ‘সধবার একাদশী’র পাঠ নিতে বলেন সবাইকে।
টিনের তলোয়ারের ক্লাইমেক্স অংশটি নাটকের শেষপ্রান্তে এসে দেখিয়েছেন উৎপল দত্ত। বেঙ্গল অপেরার রঙ্গমঞ্চের সামনে উপবিষ্ট হয়েছেন ল্যামবার্টসহ অন্যান্য রাজপুরুষ। পেছেনে কলকাতার নাটকপ্রিয় দর্শক। ‘সধবার একাদশী’র অভিনয় চলছে। বেণিমাধব নিমচা দের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। মদ খেয়ে মাতাল হয়েছেন বলে দর্শকমহলে রব উঠছে। বেণিমাধব সংলাপ বলছেন- ” ডুয়েল লড়বো। (জনতা চুপ করে গিয়েছিলো) সাহেব তোমরা আমাদের দেশে এলে কেনে ? আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষেতি করি নি। আমরা তো ছেলাম ভায়ে ভায়ে গলাগলি করো, হিন্দু-মুসলমানে প্রীতির বাহু বেঁধে বাংলাদেশের শ্যামল অঞ্চলে মুখ ঢেকে। হাজার হাজার কোশ দূরে এদেশে এসে কেনে ঐ বুট জোড়ায় মারগে দিলে মোদের স্বাধীনতা?” এই সংলাপের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলোনা কিন্তু দর্শক যেমন উল্লাসে ফেটে পড়ে তেমনি সাজঘরেও মূহুর্তে পরিবর্তন আসে। বসুন্ধরা ছুটে আসেন মঞ্চে। বলেন- “কেন এয়েছে জানোনা তিতুমীর? এরা হার্মাদ, জলদস্যু। এয়েছে লুট করতে। নারীর সতীত্ব নাশ করো, সোনার ভারতেরে ছাড়খার করো চলে যাবে- সপ্তডিঙা ভাস্যে। ” এরপরে ময়না গানে গানে তার সংলাপ বলছে, বিদেশি দস্যুর তীরে হৃদয় রুবিরধার।
প্রেক্ষাগৃহ কেঁপে উঠে দর্শকের জয়ধ্বনিতে, কোথা সে গরিমা! মহিমা কোথায়? গগনবিহারী পক্ষি ভূমিতে লুটায়। এরপর ল্যামবার্ট মঞ্চের সামনে থেকে ভয় দেখাচ্ছে কুশীলবরা তিতুমীর নাটকের সংলাপ বলছে বলে। কিন্তু দর্শক তা অগ্রাহ্য করছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের পতন চায় তারা। তিতুমীর নাটক মঞ্চায়ন বেণিমাধববাবুর টিনের তলোয়ারের প্রদর্শন হলেও নাটকের মূল শক্তি প্রদর্শিত হয়েছে এই নাটকে। অসাধারণ সংলাপগুণ ও পরিবেশন দক্ষতায় টিনের তলোয়ার নাটকটি বাংলা নাটককে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।