সার-সংক্ষেপ : কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) রচিত চতুর্থ উপন্যাস ‘আরণ্যক’। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে লেখক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অরণ্য পরিবেশের চমৎকার বর্ণনা করেছেন। মূলত, তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। পুরো কাহিনিতে সেই চিরায়ণ লক্ষ করা যায়। সত্যচরণ নামে এক যুবকের বর্ণনায় পুরো কাহিনির রূপায়ণ ঘটেছে। প্রকৃতির নিবিড় রহস্যময়তায় উপন্যাসটি এমন ভিন্নমাত্রায় রচিত যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসর, বিচিত্র রূপ, পরিবেশন গুণ আর পরিসর ব্যাপকতার জন্য একে মহাকাব্যিক কাহিনি নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। উপন্যাসে নানান দিক এর পাশাপাশি লোকউপাদান সম্পর্কেও লেখক মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশিষ্টতা পেয়েছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি। প্রকৃতি ও লৌকিকতাই একে এই বিশিষ্টতা দান করেছে। যেখানে রয়েছে জ্বিন-পরী, উড়ুক্ত সাপ, জীবন্ত পাথর সংক্রান্ত লোকবিশ্বাস, অনার্য দেবতা ও রাজা কেন্দ্রিক মিথ, গ্রাম্যমেলা ও লোকউৎসবকেন্দ্রিক নানা লোকাচার, ব্রাহ্মণাচার, নারীকেন্দ্রিক উৎসব ইত্যাদির সমন্বয়ে এক লৌকিক ধারা বহমান উপন্যাসটিতে। সেই ধারা, সেই সাথে উপন্যাসে উল্লেখিত লৌকিক উপাদান অনুসন্ধান করাই আলোচ্য প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য।
ভূমিকা
মানব সভ্যতার অতি প্রাচীন অংশ লোকসংস্কৃতি। কিন্তু সাহিত্যে এর প্রয়োগ খুব বেশিদিন আগের নয়। বাংলায় লোকসংস্কৃতির চর্চা অনেক অর্বাচীন সময়ের ঘটনা। সচেতনভাবে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালির অনুরাগ রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে; বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীই বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রারম্ভিক পর্ব।’ (চৌধুরী, ২০১৪) ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যের গতিধারা পরিবর্তিত হতে শুরু করে। বিশেষ করে-
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রাম জীবনের প্রতি বাড়তি নজর দান লোকসংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা বা সংযোজন এনে দিয়েছেন। নতুন ও অপরিচিত চমক দেওয়ার জন্য গ্রামজীবন ও লোকসংস্কৃতির প্রতি অধিক জোর দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের বিচিত্র মানুষ এবং তার বিচিত্র পেশা ও সংস্কৃতির বাংলা উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছে। বাংলা উপন্যাসের কাহিনীগত বিকেন্দ্রীকরণের ফলে নতুন একটা দিগন্ত খুলে গেল। বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন একশ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটলো আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। (চৌধুরী, ২০১৪)
নতুন ধারা সংযোজনের মধ্যে যিনি অন্যতম তিনি হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে অরণ্য প্রকৃতি নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’। এ প্রসঙ্গে বলা যায়-
আরণ্যকের প্রাণ বিশাল গহন অরণ্য, বাংলার প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে, আদিম বনভূমিকে প্রাধান্য দিয়ে এত বড় উপন্যাস আগে লিখিত হয়নি। পাহাড়ি অরণ্য, অরণ্য লালিত নির্জনতা, গাছপালা, শ্বাপদকুণ্ডা, ভয়, পরী, দেবতা রাসবিহারী সিংহ এর মতো মহাজন, রাজু পাঁড়ের মতো কবিরাজ, যুগল প্রসাদের মতো প্রকৃতিপ্রেমিক – এই আয়োজন বাংলাসাহিত্যে দেখা যায় না। (বাংলা অ্যাকাডেমি, ২০২০ )
বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-কে প্রকৃতির পাঁচালী বলা হয়ে থাকে। আরণ্যক উপন্যাস লেখার পেছনে লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায় এই আরণ্যক নিয়ে বিভূতিভূষণ তাঁর ডায়েরিতে নানা কথা লিখেছেন। বিশেষ করে ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাগলপুর থাকাকালীন সময়ে লেখক এটি লেখার কথা চিন্তা করেন। ঐ সময় পঙ্গুরিয়া ঘাটা এস্টেটের সহকারী ম্যানেজার হিসেবে ইসমাইলপুর এবং আজমাবাদের অরণ্য পরিবেশে থাকার ফলে আজন্ম নিসর্গরূপকার লেখক ব্যাপক পরিভ্রমণ ও নানা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। চাকরির দরুণ তিনি যা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন, উপলব্ধি করেছেন, তারই জীবনঘন বর্ণনা পাওয়া যায়। আরণ্যক উপন্যাসে। এই সময়ে তাঁর দিনলিপি গ্রন্থ ‘স্মৃতির রেখা’-তে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়- এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা। এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো- একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল ব্রাত্য জীবনের ছবি। (মৈত্র, ২০২০ ) বিভূতিভূষণের আরণ্যকে লৌকিক উপাদান অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় নানান বিষয়ের রেখাপাত ঘটেছে পুরো কাহিনীময়।
লোক উপাদান প্রসঙ্গে
‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি মূলত প্রকৃতিপ্রেমের রূপায়নে লোকায়তধর্মী উপন্যাস । যাতে মানুষ ও প্রকৃতির সেতুবন্ধনে সমকালীন অবস্থান, প্রতিবেশকে লালন করেছে। এই পরিবেশের প্রতিবেশ বোঝার জন্য লৌকিকতা বা লোকায়ত অনুষঙ্গ বা উপাদান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইংরেজিতে ফোক বা বাংলায় ‘লোক’ বলতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একক কোনো সত্তাকে নির্দিষ্ট করা হয় না। যাপিত জীবনের কোনো দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট তথা স্বতন্ত্র সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারা সৃষ্টিকারীদের বোঝানো হয়। আর তাদের সৃষ্ট সংস্কৃতিই হচ্ছে লোর বা সংস্কৃতি। এখানে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়
দীর্ঘদিনের স্থিত হওয়া সংস্কৃতিকে লালন করা হয় যার মূলে বংশ পরম্পরা প্রেক্ষাপটটি জড়িত।
লোকায়ত সংস্কৃতিতে যুক্তি তর্ক ও বিজ্ঞানের পরিক্ষীত ধারণার বিপরীতে থাকে বদ্ধমূল বিশ্বাস, আবেগ একতাবদ্ধতার প্রেরণা যা কিনা সেই গোষ্ঠীকে একটি দীর্ঘ সময় ধরে একক সত্তায় আবদ্ধ করে রাখে। পাশাপাশি ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের থেকে আলাদা করে। লোকজীবন ঘরানায় চর্চিত বিষয়সমূহকে দুইটি ভাগে বিভাজিত করা যায়।
বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে পোশাক, খাদ্য, লোকশিল্প, বাদ্যযন্ত্র, লোকযান ইত্যাদি। আর অবস্তুগত সংস্কৃতিধারায় রয়েছে লোকসাহিত্য বা বাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, লোকসংগীত, লোকগীতিকা। বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতিযোগে দেশ, কাল, সমাজ ও ধর্মভেদে পালিত হয় নান উৎসব- আচার ও নিয়ম-নীতি। লোকসংস্কৃতি লোকসমাজেরই সৃষ্টি বিধায় তা হারিয়ে যায় না বরং পরিবর্তিত মননশীলতার সাথে বিবর্তিত হয়।
উপন্যাসে লৌকিক উপাদান- অনুসন্ধান
বিভূতিভূষণ তাঁর আরণ্যকে লোকায়ত জীবন ঘরানায় বস্তুগত ও অবস্তুগত দুটিরই সমন্বয় করে উপন্যাসে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। আরণ্যকে সামন্তযুগ অর্থাৎ জমিদারপ্রথার তৎকালীন সমাজ জীবনের স্বচ্ছ ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্য সবসময় মানুষের কথা, সমাজের কথা প্রকৃতির কথা বিবেচনা করে তার অনুসরণেই রচিত হয়। যেনো তা সমসাময়িক পাঠক ও সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়। অবশ্য-
কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিবেশ একটা ফ্রেমের কাজ করে মাত্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামীণ জীবনের কথাশিল্পী। প্রকৃতি তন্ময়তা তাঁর নিজস্ব ঘরানা। তাঁর উপন্যাসে মানুষ ও অরণ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অথচ তার উপন্যাসের পটভূমি কিন্তু একান্তভাবেই আঞ্চলিক নয়। নির্জনতা প্রিয় এই মানুষটি স্মৃতিমেদুর হয়ে অরণ্য ও মানুষের নিবিড় বন্ধনে ইতিবৃত্ত শুনিয়েছেন। (চৌধুরী, ২০১৪)
আরণ্যকের পরিসরের ক্ষেত্রে উত্তরে আজমাবাদ থেকে দক্ষিণে কিষণপুর এবং পূর্বে ফুলকিয়া বইহার থেকে পশ্চিমে লবটুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানকার সমাজ জীবন ও সেই পরিবেশের চিত্রায়ণে অবধারিতভাবেই লৌকিকতা চলে এসেছে। কেননা লেখক যে সমাজের জল, মাটি, বাতাস- প্রাকৃতিক প্রতিবেশে বেড়ে উঠেছে তার কল্পনাশৈলী ও মনোজগতের ভাবধারাটি সে জায়গাটিকেই যে গ্রহণ করবে তা ধ্রুব সত্য।
‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে রচিত হয়েছে। এখানে কথক সত্যচরণের জবানিতে বর্ণিত হয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে সেই নায়ক। তবে তা উপন্যাসের প্রকৃতির আবেদনের কাছে অনেকটাই উহ্য। উপন্যাসের প্রথমেই আমরা পেয়েছি ওয়ার্ড সিক্সের বন্ধু অবিনাশকে, যাদের বিশ হাজার বিঘের জঙ্গল মহাল আছে। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় সত্যচরণ ঐ মহালের ম্যানেজার রূপে নিযুক্ত হন। শুরু হয় নিবিড় অরণ্য জীবন।'(চৌধুরী, ২০১৪) সত্যচরণ কলকাতা নিবাসী ছিলো। শহরের জীবনে বন্ধুবান্ধব আড্ডা স্ফূর্তিতে কাটলেও এখানে অরণ্যের নিঃসঙ্গতায় তাকে প্রথমদিকে হতাশ করে তোলে। লেখক বিভূতিভূষণ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শহর ও গ্রামীণ সমাজের লৌকিক পার্থক্যকে দেখিয়েছেন। লৌকিক জীবন মূলত- বৈচিত্র্যময় বিশ্বাস, আচার কল্পনামিশ্রিত এক জীবনের কথা বলে। মানুষ যে সবসময় শেকড়ের ভক্ত তা দেখা যায় সত্যচরণের অরণ্যপ্রীতি দেখে।
‘কথক সত্যচরণ গণুর মুখে শোনেন উড়ুক্কু সাপের কথা, জীবন্ত পাথর ও আঁতুড়ে ছেলের হেঁটে বেড়াবার কথা, যা রূপকথা বা কল্পনা নয়। ঐ পরিবেশে গণুর একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। (চৌধুরী, ২০১৪)পশু-প্রাণী উড়তে পারে পাখির মতো এমন কল্পনাগাঁথা রূপকথা গল্পে দেখা যায়। গল্পের এ কল্পনা তো এমনি এমনি আসেনি। একটি সংঘবদ্ধ সমাজের দীর্ঘদিনের কল্পনামিশ্রিত বাস্তবতা ভিত্তিক রূপকথাগুলো। যে কল্পনাকে আধুনিক বিজ্ঞান আজ হেলোসিনেশন বলে তা আরণ্যকের সমাজে ছিলো চিরসত্য যা পড়ে আমাদের কখনই অবাস্তব মনে হয় না। সাপ উড়তে পারে, পাথর জীবন্ত এবং সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি হেঁটে বেড়াচ্ছে- এ বিষয়গুলো নিশ্চয় গণুর ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশ্বাসে স্থিত হয়নি। অবশ্যই গণুর সমাজের বড় একটি অংশের বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরণ্যকের লৌকিক অধিবাসীরা শুধু বিশ্বাসে ক্ষান্ত থাকেনি। বিশ্বাসকে আচারে রূপান্তরিত করেছে।
খাদ্যাভ্যাসে লৌকিক-সংস্কার
উৎসব ও ভোজনপ্রিয় বাঙালি কখনও একা তাদের সত্তাকে লালন করেনি বরং সমাজের অন্যান্য মানুষকে সাথে নিয়েছে। ফলে তাদের মনস্তত্ত্বে তারা কতটা অতিথি পরায়ণ সে ধারণা পাকাপোক্ত হয়েছে জীবন সংসারে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতিথিকে নারায়ণ ভাবা হয়, দেবতাতুল্য সমাদর করা হয় তা খুঁজে পাওয়া যায় উপন্যাসের চরিত্র নন্দলাল ওঝার আতিথেয়তার মধ্যে।
সে মৈথেলী ব্রাহ্মণ, বাড়ি সুংঠিয়াদিয়ারাতে। পূর্ণিমার দিন সত্যচরণকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য একটি হাতি পাঠিয়ে দেয়। গ্রামে ঢোকার সময় দেখা যায়, পথের দুধারে সারি বন্দী মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে ঢোকার সময় অতিথি আপ্যায়নের রীতি অনুযায়ী দু’বার বন্দুকের ‘ফায়ার’ হয়। সত্যচরণ ভেতরে বসতেই দেখা গেল, দশ এগারো বছরের একটি বালিকা একটি থালায় গোটাকতক আন্ত পান, আন্ত সুপারী, মধুপার্কের বাটিতে সামান্য আতর ও কয়েকটি শুষ্ক খেজুর এনে রাখল। । এটি ঐ দেশের আতিথেয়তার এক বিশেষ পরিচয় বহনকারী। ( চৌধুরী, ২০১৪) ।
লোকায়ত সমাজের আলাদা খাদ্যাভ্যাস থাকে যা তাদের স্বকীয়তাকে বহন করে। এ খাদ্যাভ্যাস ধর্মীয় কিংবা সামাজিক রীতি সিদ্ধ। যেমন- নন্দলাল ওঝার বাড়ির খাদ্যাভ্যাসের লৌকিক সংস্কার,
প্রকাণ্ড কাঠের পিঁড়িতে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। বেশ বড় একখানা থালায় হাতির কানের মতো পুরি, বাথুয়া শাক ভাজা, পাকা শশার রায়তা, কাঁচা তেঁতুলের ঝোল, মহিষের দুধ, দই, পেঁড়া প্রভৃতি কথককে খেতে দেওয়া হয়েছিলো। এই তালিকার মধ্য দিয়ে ঐ দেশের উচ্চবিত্ত সমাজের খাদ্যাভ্যাসের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। (চৌধুরী, ২০১৪)।
ভোজনরসিক বাঙালির পরিচয় সিদ্ধির পাশাপাশি ফেরার সময় নন্দলাল ওঝা কর্তৃক কথক সত্যচরণকে পঞ্চাশ টাকা নজর দিতে চাওয়ার মাধ্যমে উপন্যাসে বর্ণিত দেশের সমাজরীতির অতিথি আপ্যায়নের এ দিকটি ফুটে উঠেছে। যা সে সমাজকে লোকসংস্কৃতির দৃষ্টকোণে স্বতন্ত্রতার পরিচয় দেয়। সব সমাজেই একটা অর্থনৈতিক শ্রেণীকাঠামো থাকে যা তাদের জীবনঘনিষ্ট। নন্দলালের আপ্যায়নে উচ্চবিত্তের পরিচয় পাওয়া গেছে। পাশাপাশি উপন্যাসের পরবর্তীতে নিম্নবিত্তের খাদ্যাভ্যাসের নমুনাও পাওয়া যায়। যখন দেখা যায়, আষাঢ় মাসে খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারের কাছারীতে পুণ্যাহ উৎসব হয়। সেখানে সত্যচরণের চাকরিসূত্রে ঐ অঞ্চলের নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্যাভ্যাসের একটি সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। মুষলধারে বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এই গরিব মানুষগুলি খেতে আসে চীনা ঘাসের দানা, টকদই, ভেলিগুড় ও লাড্ডু। এই চীনার দানা নুন সহযোগে তারা পরমানন্দে খায়। ঐ অঞ্চলের দুর্দান্ত রাজপুত মহাজন রাসবিহারী সিং-এর কাছ থেকে কথক হোলির আমন্ত্রণ পান’। (চৌধুরী, (২০১৮)।
হোলি একই সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। উৎসবের নানা আচার রীতির পাশাপাশি সেখানেও বাঙালি সমাজের অতিথি আপ্যায়নের চিত্রটি ফুটে ওঠে। নানা ধরনের প্রথার পরিচয় মেলে,
কথকের ঘোড়া উঠোনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে দু’বার বন্দুক ফায়ারিং এর মাধ্যমে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। কিন্তু গৃহস্বামী না এলে ঘোড়া থেকে নামার প্রথা নেই। রাসবিহারী সিং-এর বড়ভাই রাস উল্লাস সিং তাঁকে করজোড়ে অভ্যর্থনা জানায়। কিছু পরে এক বালক একটি বড় থালায় আবির, কিছু ফুল, কয়েকটি টাকা, গোটাকতক চিনির এলাচদানা, মিছরিখণ্ড এবং একছড়া ফুলের মালা রেখে যায় কথকের নজররূপে। এদেশের উচ্চবিত্ত রূপে সেই প্রতিপন্ন হয়, যে বিকানীর মিছরি খেয়ে জলযোগ করে। তার বাড়িতে কথককে খেতে দেওয়া হয় বৃহত্তদাকার খান পানের পুরী, খুড়িতে নানা রকম তরকারি, দই, লাড্ডু, মালপোয়া, চাটনি, পাঁপর। হোলি উৎসব উপলক্ষ্যে নাটুয়া বালক ধাতুরিয়া সকলকে নাচ দেখায়। নাচ দেখানোর পুরস্কারস্বরূপ সে খেতে পায় মাড়া, দই, চিনি। গাঙ্গোেতাদের বাড়িতে নাচ দেখালে পায় আধসের মকাইয়ের ছাতু। চৌধুরী, ২০১৪)
বিভূতিভূষণের আরণ্যক সে সময়ের কথা বলে যে সময়ে ধান-চালের ফলন কম হওয়ায় তা নিম্নবিত্তের আহারের সীমার বাইরে থাকে। ফলে এখানকার লোকেরা ভাত খেতে পায় না।
ভাতের পরিবর্তে খায় মাটো অর্থাৎ মকাই সেদ্ধ। শ্রাবণ মাসে এখানকার লোকেরা জংলী হরিতকীর আচার তৈরি করে। সত্যচরণ অনার্য প্রাচীন রাজা দোবরু পান্নার কাছে যাওয়ার সময় ভেট স্বরূপ নিয়ে যান কিছু ফলমূল, গোটা দুই বড় মুরগি। প্রাচীন অরণ্যচারী রাজা কথককে স্বহস্তে রান্না করে খেতে বলেন। খাদ্য স্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয় সজারুর মাংস, চাল, মেটে আলু, দুধ ও মধু। আতিথ্যের যাতে কোনো ত্রুটি না ঘটে সেজন্য রাজ্য দোবরু পান্না সারাক্ষণ রান্নার কাছটিতে বসে থাকেন। অনার্য রাজবংশের অতিথি আপ্যায়নের সরল অনাড়ম্বর চিত্রটি এখানে ফুটে উঠেছে। এখানে জলের উৎস রূপে উল্লিখিত হয়েছে উর্দুই পাথরের গর্তে একটু একটু করে জল জমে। এক আধ ঘন্টায় আধসের জল হয়, যা অত্যন্ত পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা। (চৌধুরী, ২০১৪)
সম্পর্কের সুষমমণ্ডিত রূপটি আতিথেয়তার বাইরে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষিত হয় সখীদের সাথে আলিঙ্গনের মুহূর্তটিতে। এখানের একটি প্রথা হলো ‘গ্রামের মেয়ে বা কোনও প্রবাসিনী সখী, কুটুম্বিনী বা আত্মীয়দের সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হইলেই উভয়ে উভয়ের গলা জড়িয়ে মায়াকান্না জুড়ে দেবে। অপরিচিত কেউ ভাবতে পারে তাদের কেও বোধ হয় মারা গেছে। প্রকৃতপক্ষে এটি আদর আপ্যায়নের একটা অঙ্গ। না কাঁদলে নিন্দা হবে। মেয়েরা বাপের বাড়ির মানুষ দেখে কাঁদে না- অর্থাৎ তাহলে প্রমাণ হয় যে, শ্বশুরবাড়িতে বেশ সুখেই আছে- মেয়ে মানুষের পক্ষে এটা নাকি লজ্জার কথা । (চৌধুরী, ২০১৪) বিশ্বাস-আচার খাদ্যাভ্যাস, আপ্যায়ন রীতির যে লৌকিকতার পরিচয় সিদ্ধ হয় তার সাথে প্রকৃতির এক অনন্যসাধারণ মেলবন্ধনে উপন্যাসটি সার্থকতা পেয়েছে।
লোকউৎসবে জীবনাচার
সমাজে বিদ্যমান লৌকিক উপাদানের অনুসন্ধানে উৎসব ছাড়া লোকায়ত সমাজকে কল্পনা করা যায় না। কেননা উৎসব আচারের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে চেনা যায়, আলাদা সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। সে সত্তায় চেতনাৎসারিত হয়ে বিভূতিভূষণ তার মনঃপুত কথাগুলোই যেনো আরণ্যকের সত্যচরণের অনুভূতিতে ব্যক্ত করেছেন। যেমন- শ্রাবণ মাসে কাছারীর পুণ্যাহ উৎসব পালিত হয়। জমিদার তার খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে মিষ্টান্ন ভোজের মধ্য দিয়ে এ উৎসবের আয়োজন করেন।
জঙ্গল মহলের পূর্ব-দক্ষিণ সীমানা থেকে সাত-আট মাইল দূরে ফাল্গুন মাসে হোলির সময়ে একটা প্রসিদ্ধ গ্রাম্যমেলা বসে যা ‘মৈষণ্ডীর মেলা’ নামে পরিচিত। কড়ারি-তিনটাঙা, লছমনিয়াটোলা, ভীমদাসটোলা প্রভৃতি জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকজন বিশেষতঃ মেয়েরা আসে। তাদের মাথায় পিয়াল ফুল অথবা লাল ধাতুপ ফুল গোঁজা থাকে। কারো বা মাথার বাঁকা খোঁপায় কাঠের চিরুনী আটকানো থাকে। তারা পুঁতির দানার মালা, সম্ভা জাপানি বা জার্মানির সাবানের বাক্স বাঁশি, আয়না অতি বাজে এসেন্স ক্রয় করে। পুরুষেরা এক পয়সায় দশটা কালি সিগারেট কেনে। বাচ্চারা তিলুয়া, রেউড়ি, রামদানার লাড্ডু ও তেলেভাজা কিনে খায়। (চৌধুরী, ২০১৪)
সাধারণ মেলার মতো এই মেলাতেও হিন্দি গোলেবকাউলী, লায়লা মজনু, বেতাল পঁচিশী, প্রেমসাগর ইত্যাদি বই বিক্রি হয়। মেলার মধ্যে যারা রেঁধে খাচ্ছে, তাদের জন্য বিক্রি হয় কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় শুটকি, কুঁচো চিংড়ি ও নালসে পিঁপড়ের ডিম যা ঐ অঞ্চলের একটি প্রিয় সুখাদ্য। তাছাড়া কাঁচা পেঁপে, শুকনো কুল কেঁদ ফল, পেয়ারা ও বুনো সীম বিক্রি হয়।’ (চৌধুরী, ২০১৪) গ্রামের একটি মেলাতে যা যা থাকে তার সবই এই মেলাতে রয়েছে। গ্রাম্যমেলার একটি বিষয় উল্লেখ্য যে এখানে নানা আয়োজনের ভিতর তাদের স্বীয় লোকবিশ্বাসে স্থিত আচার-রীতি যুক্ত থাকে। আবার গণু মাহাতো কথিত ‘হরিহর ছত্র মেলা’র পরিচয়ও এই উপন্যাসে পাওয়া যায়, যেখান থেকে ছটু সিং ঘোড়া নিয়ে আসত। সেই ঘোড়াকে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য জমৈতি আর ফনৈতি -দু’রকমের নাচ শেখানো হতো।’ (চৌধুরী, ২০১৪)
বাংলায় লোকায়ত ধর্মের লোকজীবনের সূচনা করে অনার্যরা। আর্যরা এসে শাস্ত্রীয় ধর্মভিত্তিক জীবন-যাপন করেছে। অনার্যদের লোকজীবনের বিভিন্ন উৎসবের কথা আরণ্যকে উল্লেখ পাওয়া যায়।
অনার্য রাজা দোবরু পান্নাদের একটি বহু প্রাচীন অনুষ্ঠান হলো ঝুলন। এই উৎসবে বহু দূর থেকে আত্মীয়-স্বজন আসতো নাচতে। আড়াই মণ চালের রান্না হতো। পাহাড়ের পাদদেশের সমতলে প্রাচীন পিয়াল গাছের নিচে, জ্যোত্রা রাত্রিতে ত্রিশজন কিশোরী তরুণী ঐ গাছটিকে ঘিরে নাচতো। পাশে পাশে মাদল বাজিয়ে একদল যুবকও নাচতো। মেয়েদের খোঁপায় থাকতো ফুলের মালা ও গায়ে ফুলের গহনা। এছাড়াও এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পূর্ণিয়ার হো হো নাচ ও মুঙ্গেরের গেঁয়ো নাচ। (চৌধুরী, ২০১৪)
উপন্যাসে উল্লেখিত লোকউৎসবগুলোর মধ্য দিয়ে তৎকালীন মানুষের জীবনাচারের চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বলা যায়, লোকউপাদানগুলো লোকসমাজের দর্পণ -এর পরিচায়ক।
লোকভাষা ও জীন পরীদের প্রসঙ্গ
লোকভাষা একটি জনপদকে পরিচিত করতে সমৃদ্ধ করতে বেশ প্রভাবক। ভাষা একটি লোকজ জাতির অন্যতম নিয়ামক। যা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে পৃথক সত্তায় ধারণ করে রাখে। এ প্রসঙ্গ আলোচনায় ‘আরণ্যক’ উপন্যাসেও এ ধরনের আঞ্চলিক ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়, তার নাম ছিকাছিকি ভাষা’। গ্রামীণ সমাজজীবনে অদৃশ্য বিশ্বাস যে কতটা ঘনীভূত হতে পারে তা প্রারম্ভিক উড়ুক্কু সাপ, কিংবা জীবন্ত পাথরের গল্পে জানা যায়। উপন্যাস কথকের ভাষ্যে বিশ্বাস-সংস্কারকেন্দ্রিক এ সংক্রান্ত লোকউপাদানের পরিচয় আরও পাওয়া যায় এখানের বাসিন্দা আমীন রঘুবরের গল্পে। জীন পরীদের প্রসঙ্গে –
আমীন রঘুবর প্রসাদের কাছে কথক হুরী পরীদের কথা শুনেছিলেন। সরস্বতী কুণ্ডীতে জ্যোত্মা রাতে তারা ডাঙায় পাথরের ওপর কাপড় খুলে জলে নামে। সে সময় যে তাদের দেখতে পায়, তাকে ভুলিয়ে জলে নামিয়ে ডুবিয়ে মারে। জ্যোন্ডার মধ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায় পরীদের মুখ জলের ওপর পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে। আবার বোমাইবুরুর জঙ্গলে বটতলায় একদল অল্পবয়সী মেয়ে হাত ধরাধরি করে জ্যোতার মধ্যে নাচে। এদেশে ওদের বলে ‘ডামাবানু’ এক ধরনের জীন পরী নির্জন জঙ্গলের মধ্যে থাকে। মানুষকে বেঘোরে পেলে মেরেও ফেলে। (চৌধুরী, ২০১৪)
এছাড়াও উপন্যাসে-
ঐ অঞ্চলের এক অদ্ভূত ঘটনার পরিচয় পাওয়া যায়। রামচন্দ্র আমীন ও তার ছেলে দুজনেই গভীর রাত্রিরে একটি সাদা কুকুরকে দেখেছে তাদের ঘরে ঢুকতে। জেগে উঠলেই দেখা যায় কুকুরটা পালাচ্ছে পরক্ষণেই সেটি একটি মেয়েতে পরিণত হয়। জানালার পাশ দিয়ে পেছনের জঙ্গলে হারিয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায় বোমাইবুরুর জঙ্গলে সেই বৃদ্ধ ইজারাদারের ছেলের মৃত্যু হয়েছে। (চৌধুরী, ২০১৪)
মানুষের একটি সহজাত স্বভাব হচ্ছে নিজের রোমাঞ্চিত ভাবটি অন্যের কাছে প্রকাশ করা। উল্লেখিত গল্পের ঘটনাগুলো সহজ-সরল গ্রামীণ জনপদের রোমাঞ্চিত রেশকে ধরে রেখেছে।
মিথকেন্দ্রিক বিশ্বাস
বাংলার প্রাচীন লৌকিক জনগোষ্ঠীদের অনেক প্রাচীন মিথ বাংলার সাহিত্য ভাণ্ডার ও লোকসংস্কৃতিকে আরাধ্য করেছে। যেমন উপন্যাসে,
অনার্য রাজপরিবারের দেবতা টাঁড়বারোর পরিচয় পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। তিনি হলেন বুনো মহিষের দেবতা। তাঁর রূপের বর্ণনায় দেখা যায়, দীর্ঘাকৃতি কালো মতো পুরুষ নিঃশব্দে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক লম্বা সে মূর্তি। তিনি না থাকলে শিকারীরা চামড়া আর শিল্পের লোভে বুনো মহিষের বংশ নির্বংশ করে ছেড়ে দিত। তাই তিনি বুনো মহিষকে রক্ষা করেন। জঙ্গলের মধ্যে একটা খাড়া সিঁদুর মাখা পাথর। রাজবংশের কুলদেবতা। পূর্বে এখানে নরবলী হতো। এখন পায়রা ও মুর্গী বলি প্রদত্ত। এছাড়াও এই উপন্যাসে উঠে এসেছে অসংখ্য জাতির মানুষ ও তাদের বিচিত্র জীবন কাহিনী। মৈথিলী ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে গাঙ্গোতা উপজাতি, রাজপুত বুস্তা থেকে সাঁওতাল রাজকন্যা ভানুমতী প্রভৃতি চরিত্রের নিটল বুনটে এই উপন্যাস হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলের জীবনযাত্রার ইতিহাস। (চৌধুরী, ২০১৪)
উপন্যাসে পৌরাণিক কাহিনি বর্ণনায় একই সাথে বাংলায় রাজ-রাজরাদের আমল এবং আদিতে যে মানুষ যাযাবর ও শিকারি হিসেবে দিনাতিপাত করেছে তার কথা আলোচিত হয়েছে। যা প্রাচীন লোকায়ত সমাজব্যবস্থার একটা দৃশ্যপট লেখক সূক্ষভাবে তুলে ধরেছেন। আরণ্যকের বাইরেও অন্যান্য উপন্যাস লেখাতেও বিভূতিভূষণ কখনই মাটির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস নেননি।
ব্রাহ্মণাচার
পুণ্যের আশায় ব্রাহ্মণভোজন বাঙালি সমাজের এক অতি প্রাচীন সংস্কার। পূর্বে যার যার সাধ্যানুযায়ী ব্রাহ্মণভোজন করাতো পূজা-অর্চনায় সম্পৃক্ত থাকায় তারা বিশেষ সমাদরে থাকতো গৃহস্থ জীবনে। আরণ্যক উপন্যাসেও এ চিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। উপন্যাসে বর্ণিত সমাজে ‘সেই সময় অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা ব্রাহ্মণ ভোজন করাতো, তার পরিচয় পাওয়া যায় নালুপাল যখন চন্দ্র চাটুজ্জের বাড়িতে ব্রাহ্মণ ভোজা গ্রামে গরিব ব্রাহ্মণেরা এই ধরনের ফলার গ্রহণ করে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতো। নফর মুচি, আমীন প্রসন্ন চক্রবর্তী, গয়ামেম, হলাপেকে ফণি চক্কোত্তি, চন্দ্র চাটুচ্ছে, রূপচাঁদ মুখুজ্জে, নীলমণি সমাদ্দার এইসব সাধারণ ব্রাহ্মণদের জীবনের সুখ-দুঃখ, বাসনা কামনার ছবি ফুটে উঠেছে।'(চৌধুরী, ২০১৪) ব্রাহ্মণরা পূজা-অর্চনার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো বিধায় তারা তেমনভাবে কোনো ব্যবসায় বাণিজ্য বা চাকুরির সাথে যুক্ত হতো না। ফলে তাদের অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। যার কারণে তাদরে ব্যক্তিজীবনের নানা কায়ক্লেশ এর কথা উঠে এসেছে।
নারীকেন্দ্রিক উৎসব ও লোকছড়া
লৌকিকতার উৎসব আচার শুধু পুরুষের মধ্যে বদ্ধমূল থাকেনি। যুগে যুগে নারীরাও অংশ নিয়েছে নানা উৎসবে, সৃষ্টি করেছে মেয়েলি গীতসহ নানা লোকজসংস্কৃতির। সত্যচরণের বর্ণনায় দেখা মেলে, ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে পাঁচপোতা গ্রামের বৌ-ঝিদের মিলনমেলা বহু পুরাতন শিউলী ও কদম গাছের তলায় তেরের পালুনী অনুষ্ঠিত হতো।
এই অনুষ্ঠানে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ভুলে সকলে একসঙ্গে এই অনুষ্ঠান পালন করতো। অবস্থাসম্পন্ন নালুপালের বৌ তুলসী দরিদ্র যতীনের বউ এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাছ থেকে খোল নিয়ে তাকে দিয়েছে দু’খানি ফেণী বাতাসা আর চারটি মর্তমান কলা। তিলু বিলুও খেতে এসেছে। সকলে ওদের নানা খাবার জিনিস দিয়েছে। খাতির করে মিষ্টি কথাও বলেছে। এইসব খাবার জিনিসের মধ্যে আছে চিনির মঠ, দুধ, আখের গুড়ের মুড়কি, খই, কলা ও নানা খাবার। আমের মধ্যে হীন অবস্থা যার, সেই নীলমণি সমাদ্দারের পুত্রবধূর সাথে খাবার ভাগ করে নিয়েছে। তেরের পালুনীর দিন মেলামেশা ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার থাকে না। (চৌধুরী, ২০১৪)
বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে সবচেয়ে প্রাচীন উপাদান লোকছড়া। নিছক বিনোদনের আদলে সমসাময়িখ সমাজের বিভিন্ন ইস্যু উপস্থাপিত হয় এই লোকছড়ার মাধ্যমে। সব সমাজেই বিভিন্ন সময়ে মানুষের মুখে মুখে নানান ধরনের লোকছড়ার সৃষ্টি হয়েছে। আরণ্যকেও সেই দৃশ্য উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।
ফণি চক্কোত্তির বিধবা বোন বিধুনিনি, তিলুর অনুরোধে হাত নেড়ে একসময় ছড়া কাটতে শুরু করেন। ছড়াটি হলো- “আজ বলচে যেতে / পান সুপারী খেতে/পানের ভিতর মৌরী বাটা / ইচ্ছে বিস্কে ছবি আঁটা/ কলকেতার মাথা ঘষা / মেদেনীপুরের চিরুনি/এমন খোঁপা বেঁধে দেব/ চাঁপা ফুলের গাঁথুনী / আমার নাম সরোবালা / গলায় দেব ফুলের মালা।” সরোবালা অর্থাৎ বিদুর নামে ছড়া বানানোয় সেও রাগ দেখিয়ে ছড়া কেটেছে- “চালতে গাছে ভোমরার বাসা / সবকোণ নেই তার এককোণ ঠাসা…”। এরপর তার অনুরোধে বিষুদিদি নিধুবাবুর টপ্পা গেয়েছে হাত নেড়ে ঘুরে ঘুরে- ‘ভালোবাসা কি কথার কথা সই, মন যার সনে গাঁথা / শুকাইলে তরুবর বাঁচে কি জড়িতা লতা/ মন যার সনে গাঁথা”। এরপর সকলের অনুরোধে ভজগোবিন্দ বাঁডুজের পুত্রবধূ অল্পবয়সী লাজুক শ্যামবর্ণা নিস্তারিণী মিষ্টি গলায় গেয়েছে শ্যামা বিষয়ক একটি গান- “নীল বরণী নবীনা বরুণী নাগিনী জড়িত জটা বিভূষিণী ..।” গান শেষ হতেই তিলু তার হাতে একটা আস্ত চিনির মঠ গুঁজে দিয়েছে। এতে সে বোধ হয় একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে অতগুলি বড় বড় মেয়ের সামনে। এরপর ঠাকুর জামাই ভবানী এসে উপস্থিত হলে তার সঙ্গে রঙ্গ রসিকতায় মেতে উঠতে বাধেনি। ভবানীর একটি কথায় হাসির বন্যা বয়ে গেছে তাদের মধ্যে। এই হাস্য পরিহাসের মধ্যে কদম ডালের ঝাউরোদ কাশ ফুলের দুলুনি দিন মোপটে ভাদ্রের এক অপরাহ্নে ইছামতী নদীর ধারে জমে উঠেছে তেরের পালুনীর ব্রত উদযাপন উৎসব।( চৌধুরী ২০১৪)
তেরের পালুনীর উৎসব মনে করিয়ে দেয় বিত্ত-সম্পত্তি যার যার, উৎসব সবার। এখানে নেই কোনো রাগ কিংবা হিংসা ক্রোধের অনল। শুধুই আনন্দ-ফূর্তিতে একে অন্যকে আলিঙ্গন করা। বাঙালি জীবনের উৎসবকেন্দ্রিক আলিঙ্গন-ভালোবাসার পরিচয়কে সিক্ত করেছে বিভূতিভূষণকে।
বিভূতিভূষণ মূলত পল্লীজীবনের রূপকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী নীলকর সাহেবদের আমল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কাল পর্যন্ত বাংলার বিশেষত চব্বিশ পরগনার গ্রামীণ জীবন, মানুষ ও তাদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যা বিভূতিভূষণের রচনায় অপরূপ রূপ পেয়েছে। আর সঙ্গত কারণেই তার রচনায় গ্রামীণ মানুষের লোকায়ত জীবন ফুটে উঠেছে অনাবিলভাবে। এ বিষয়ে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘অশনি সংকেত’, ‘কেদার রাজা” প্রভৃতি উপন্যাস এবং গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনের দুঃখ-দারিদ্র্য ভরা কাহিনি নিয়ে তার উপন্যাস নতুন রূপ লাভ করেছে। হয়তো এক একটা রচনায় সামগ্রিক লোকসংস্কৃতির পরিচয় নেই, তবু বিষয়টি বাংলা কথাসাহিত্যের পক্ষে শুভ শুধু নয়, গতানুগতিক বিষয়ের ভিড় এড়িয়ে টাটকা বাতাস পাওয়ার আশ্বাসে ভরপুর। আর এখানেই তিনি কালজয়ী সাহিত্যিক। (চৌধুরী, ২০১৪)
উপসংহার
লোকসংস্কৃতি সবসময় গতিশীল ও পরিশীলিত ধারা। লোকসমাজের সৃষ্ট হওয়া এ সংস্কৃতি মানুষের প্রাণের স্পন্দন থেকে উৎসারিত। অন্যদিকে লেখকবৃন্দরা সবসময় তাদের রচনায় মানুষের আবেগ ও মনোযোগ আকর্ষণে মানুষের জীবনঘনিষ্ট রূপকেই বেছে নেন। এক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি কার্যকরী। লোকসংস্কৃতির রিপ্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে একে উপন্যাসের মাধ্যমে নতুন করে পরিচয় করিয়ে অনন্য স্বার্থকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন যেসব লেখকেরা, তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। এই উপন্যাসে লেখক প্রকৃতির নিবিড় রহস্যময়তা, মায়ালোক আর আদিমতায় খুঁজে পেয়েছেন জীবনের গাঢ়তম রূপ, দেখেছেন মানুষের বিচিত্র প্রবণতা আর উপলব্ধির নব রূপায়ন। মানুষের এই বিচিত্র প্রবণতা আর নব রূপায়নের রসায়নে ঐতিহ্যিক প্রতিবেশে বিনির্মাণ হয়েছে আরণ্যকের সমাজচিত্র। এ প্রসঙ্গে বলা যায় বিশ্বাস-সংস্কার, আতিথেয়তা, লোকউৎসব, লোকভাষা, মিথ, লোকছড়া, বিচিত্র জীবানাচারে ভরপুর লৌকিক-উপাদানে সমৃদ্ধ আরণ্যক উপন্যাসটি।
তথ্যনির্দেশ
অন্তরা চৌধুরী, “বিভূতিভূষণের উপন্যাসে লোকায়ত অনুষঙ্গ, ৩০ জুলাই ২০১৪
আবার মৈত্র, ‘আরণ্যক জীবনের মায়াজড়ানো উপাখ্যান’, রোয়ার মিডিয়া, ২৮ এপ্রিল ২০২০
বিভূতিভূষণের আরণ্যক : প্রকৃতির পাঁচালী’, আমার বাংলা অ্যাকাডেমি, ৪ জুলাই ২০২০
ড. ফজলুল হক সৈকত, “বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’: অনগ্রসর সমাজের জীবনধারা’, ২৪ জুলাই, ২০১২
নাজমাতুল আলম, ‘আরণ্যক – বিভূতিভূষণের প্রকৃতি ও মানুষ’, ২২ মে, ২০২০