গরুর গাড়িতে মাকে নিয়ে শৈশবের কাছে
মাকে নিয়ে গরুর গাড়িতে শৈশবের কাছে
পোকন চাচার গরুর গাড়িতে মাকে নিয়ে, পেছনে একাকী
বসে দু’পা দুলাতে দুলাতে খলিসাদহ কিংবা বানিয়াপাড়ায়
শৈশবের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে খুব।
মাটিরঙের পোকন চাচা নেই—গরুর গাড়িও নেই—মাও নেই
দেউড়ির কাছে ছুটে এসে দাঁড়ানো দরদী সেই সব মুখও নেই।
মায়ের দুচোখ ফাঁকি দিয়ে এক দৌড়ে ছুটে যাওয়া দুপুর
শিলাইদহ কুঠিবাড়ির বকুল তলায় কবি হওয়ার বাসনায়
ফিরে পেতে ইচ্ছে করে বকুলের ঘ্রাণে শব্দ গাঁথা,
বুকুল তলায় সেই যৌবন নেই—সেই ঘ্রাণ নেই
সেই বাসনাও নেই,
পুকুরঘাটে পা দুলিয়ে দু’বেণি করা কিশোরীর সেই মুগ্ধতাও নেই।
আঁতুড় ঘরের গন্ধে আর একবার মায়ের দুচোখে দ্যুলোক মুগ্ধতা
সবচেয়ে নিষ্পাপ নির্ভার হয়ে ফিরতে ইচ্ছে করে,
সেই আঁতুড় আপ্লুত ঘর নেই—মা’র মুগ্ধ চোখ নেই,
সেই ভাঙা চেয়ার টেবিল যেখানে ভ্যাপসা গরমে গোপনে
শরৎবাবুর কঠিন প্রেমে কেটে গেছে
কতো দুর্বহ দুপুর মধ্যরাত—ঘামে ভিজে গেছে পুরনো গামছা;
মৃত মানুষের মতো ওসব হারিয়ে গেছে কোন দূরের গহনে!
সেই জীবনের কাছে আর একবার
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে—যারা দূর দূর করে তাড়িয়েছে একদিন,
আপনজনেরা কত হাজার মাইল দূরের থেকেছে অধরা
চোখেমুখে অবজ্ঞা ও তিরস্কারের ঝাঁজ মেখে;
এখন তাদের চোখেমুখে উপচানো সম্দ্রু সমুদ্র প্রেম!
দুরন্ত শৈশব —অবাধ্য পাগলা ঝড়বৈশাখের বিশুদ্ধ শৈশব
আমার যে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আর একবার
পোকন চাচার গরুর গাড়িতে মাকে নিয়ে শৈশবের কাছে
. খলিসাদহ কিংবা বানিয়াপাড়ায়।
এই নগরে সত্যভাষণ নেই
এই নগরে সত্যভাষণ নেই
নদীদের মরে যাওয়া দেখে আমাদের কোন কষ্ট থাকে না
আগুনের খেলা দেখে অংক মেলাতে জীবন পুড়ে যায়,
ফসলের মাঠে বিষধর সাপের দখলদারিত্ম দেখে
ঘরকুনো হয়ে পড়ে থাকা-এভাবে বাঁচে দীর্ঘ আয়ু;
মস্তিষ্কের কোষে বারুদের ঝাঁজ নেই
মরে যেতে যেতেও মেরুদণ্ডহীন হয়ে বাঁচার সুখ সুখের পালকিতে,
অদ্ভুতভাবে নিরেট জীবনের দুঃখময় কথা থাকে না জীবনকাব্যে,
কেন যেন বলতে নেই লুট হয়ে যাওয়া যৌবনের কথা।
এই নগরে সত্যভাষণ নেই
নগরে নগরে অদ্ভুত সার্কাস জীবনের গল্পে ঘামের গন্ধে,
কোনো মহত্তম মধু পানের তৃষ্ণায় মেরুদণ্ড খুলে
কল্পলোকের স্তুতিতে কতো রঙঢংয়ে লালগালিচা গোলাপ সংবর্ধনা
অন্ধমোহে দৌড়াতে থাকে নির্লজ্জ সাধনায় জিহ্বা ঝুলে থাকা ক্লান্ত কুকুরের মতো,
মাথা উঁচু করে থাকা পর্বত সেও গলে যায়
গলে গলে মিশে যায় সস্তাস্রোতের লোভের প্রপাতে,
সাহসী উচ্চারণ পড়ে থাকে মরা নদীতে জীবন হারানো কঙ্কাল।
এই নগরে সত্যভাষণ নেই
ভাঙাচুরা আঁকাবাঁকা আলপথে নেই
নদীর ঢেউয়ে নেই
ফসলের মাঠে নেই
জটবাঁধা সন্নাসীর সাধনায় নেই
জীবন ও যৌবনে নেই
মস্তিষ্কের কোষে নেই
কোথাও নেই-গানে ও গল্পে জীবনে কোথাও নেই;
আত্মস্বার্থে নিজেদের মতো নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছি সত্যভাষণ!
তখন নদীর ঢেউ বুকের পশম
কুসুম দুপুরে তোমার আড়ষ্ট কণ্ঠ
ভিজে ওঠা চোখের দুকোণ
বুকের ভেতর আর্তনাদ,
দুমড়ে মুচড়ে ভেসে যায়
বাতাসের করুণ শরীরে।
কোনো এক দোয়েল তোমার কণ্ঠে
ডুবে ছিল বেদনায়
দু’চোখের পানি নিয়েছিল শুষে
ঠোঁটের রোয়ায়, পিপাসায়।
তোমার কম্পিত বুকে মুখ রেখে
দূরের দোয়েল পুড়ে বৃষ্টি চায়
ভালোবেসে রমণী তোমাকে,
তখন নদীর ঢেউ বুকের পশম ছোঁয়
তুমি তখন বেদনা ভুলে শরীরী সুঘ্রাণ।