সমাজে লোভ ও প্রতারণা যেন বেড়েই চলছে দিনের পর দিন। যেমন করে বাড়ছে প্রযুক্তির যোগাযোগ উৎকর্ষ, তেমনি বাড়ছে প্রতারণা, মিথ্যে ও ভুল প্রতিশ্রুতির। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন বিশেষ করে হিন্দু সমাজের কথা না বললেই নয়। আমাদের ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষাগুলো বাস্তব শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীরা পিছিয়ে পড়ার দলে আর নেই। তাদের আত্ম-সম্মান, আত্মপরিচয় ও উপলব্ধি জ্ঞান বেড়েছে।
এজন্য হিন্দু সমাজে নারীর অগ্রগতির জন্য চাই পুরুষের মতো সম্পত্তির সমবণ্টনের নিশ্চয়তা ও আইনের পরিবর্তন। যে-কোনো সংস্কার ও পরিবর্তনে যুগে যুগে সংস্কারকারীকে অত্যাচারিত-নিপিড়ীত হতে হয়েছে। আর ওই সংস্কার যখনই ফলপ্রসু হয়েছে, তখনই সংস্কারকারী হয়েছেন মহান। আমি মহান হতে চাই না আমি চাই জীবনের নিরাপদ অধিকার, চাই শিক্ষা ও যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথ যৌতুক দিয়ে কন্যা সম্প্রদান করেছিলেন ঠিকই কিন্তু কোনোটাই সুপাত্র ছিল না। বরং জামাতাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাণ্ডার শূন্যের কোটায় চলে গিয়েছিল। যারা মনে করেন বড় কর্মকর্তার কাছে টাকার অঙ্কে কন্যা সম্প্রদান করবেন, তারা কন্যার জন্য ঠিক পাত্রটি পছন্দ করতে পারেননি। এর দায় আপনি এড়িয়ে গিয়ে শান্তি পেলেও এ সমাজ ব্যবস্থার দায় সুশীল সমাজ এড়াতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ১৬টি যৌতুক বিষয়ে গল্প রয়েছে। এগুলো হলো: ‘দেনা পাওনা’, ‘কঙ্কাল’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘সুভা’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ঠাকুরদা’, ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অপরিচিতা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘তপস্বিনী’ ও ‘পাত্রপাত্রী’। যৌতুকে ‘স্ত্রী ধন’ বলা হয়। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই নারীর জগদ্দল জয়ের ইচ্ছে পোষণ করেনি এবং সম্পূর্ণভাবে চায়ওনি। রবি ঠাকুর তার কনের বিয়েতে ষোলো আনা যৌতুক দিয়েছেন। বাল্যবিবাহ করিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল সমাজ ব্যবস্থার ওপর।এক কথায় সমাজের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি কন্যাদের নিয়ে। এজন্য তার লেখায় নারী অধিকার, বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের করাল গ্রাসে গিলে খাওয়া পিতার কষ্ট, ঋণগ্রস্ততা, সম্পদ হারানো বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু আজো পিতার দুঃখ লাঘব হচ্ছে না। আজকের নারীরাও সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
স্বাধীনতার পর নারীদের অগ্রগতি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং নিত্য নতুন কৌশলে, প্রযুক্তিগত ব্যবহার নারীদের জীবনযাপনক আরও কঠিন ও ভোগান্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ধর্ষণ-গণ ধর্ষণ, ধর্ষণর পর হত্যা, হত্যার পর পাঁচ-ছয় টুকরো, যৌন হয়রানি , শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, যৌতুকের হয়রানি প্রতিদিনের খবর। এসব শুনে একসময় চমকে যেতাম। এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছি। প্রতিদিনের সহিংসতা মানুষকে হিংস্র হতে অভ্যস্ত করে তুলছে। হিংস্রতাই যেন সমাজের অন্য নাম, বিবেকের বিসর্জন দিলেই বুঝি বুক ফুলিয়ে চলতে সুবিধে হয়।
কেনই বা অভ্যস্ত হবো না? যে-কোনো দিন আমার সঙ্গেও ঘটতে পারে , আমিও গণধর্ষণ অথবা যৌতুকের বলির পাঠা হতে পারি। আমার কত শত শৈশবের ইচ্ছে এমনকি এখনকার ইচ্ছেগুলোও সমাজের কাছে নিগৃহীত হয়। কারণ কাগজে-কলমে আমার চলাফেরার স্বাধীনতা আছে, সমঅধিকার আছে। বাস্তবে চারটা মেয়ে রাষ্ট্র প্রধান হলেও আমার মতো অসংখ্য মেয়ের জীবন এখনো গলাপানি পর্যন্ত কলসি ছাড়াই যে-কোনো সময় ডুবে মরতে পারে। এখনো আমরা বৈষম্যের শিকার। যৌতুকের দাবি যেন আরও একধাপে ধাক্কা দেয়।
ইসলাম ধর্ম মতে যৌতুক বা পণ একটি হারাম ও জাহেলি প্রথা। হিন্দুশাস্ত্র মতেও পণ নেওয়া পাপের শামিল, অর্থ বিনিময়ে আত্মার সম্পর্ক হয় না। কিন্তু হিন্দু পরিবারগুলোতে যৌতুক মানে আলাদা আনন্দের জোগান দেয়। বিশেষত যাদের অধিক পুত্র সন্তান আছে, তারা একলাফে হনুমান বনে যায়।
শাস্ত্রমতে, হিন্দু ধর্মে পণ নেওয়া ঘৃণ্য অপরাধ কিন্তু অশিক্ষা, স্বার্থবুদ্ধি আর অপরিসীম লোভে আজও টিকিয়ে রেখেছে পণপ্রথা। ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনে থাকা পণপ্রথার শিকড়কে উচ্ছেদ করার জন্য অধিকাংশ লোকের সাহস নেই। সাহস থাকলেই কী? লোভ তার থেকে অধিক বড়। অতীতে পৈতাধারী ব্রাহ্মণদের দাপটের সঙ্গে সঙ্গে অক্টোপাসের মতো যৌতুকের ভাইরাস জাপটে ধরেছে সমগ্র বাংলাদেশকে। পণ নেওয়া আর ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেওয়া সমান কথা। কিন্তু হিন্দু সমাজের বিবেক ভিক্ষুকের মতো ।
শৈশব থেকেই হৃদয়ে লালিত হয় পুত্র সন্তান মানে টাকা আসবে। আর কন্যা সন্তান মানে টাকা যাবে। এভাবেই সন্তানের লটারি ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় পরিবারের কর্তারা। ভাগ্য যে আমার পরিবারে বাবার পুত্র সন্তান নেই কিন্তু বাবার ভীষণ আক্ষেপ ছিল, এখনো আছে। সে যাই হোক আমরা কন্যা বা পুত্রের বৈষম্য পাইনি মায়ের কাছে। মা বলতেন, তোমরা ভালো পড়াশোনা কর দেখবে অন্য মানুষের ছেলেরাও তা পারবে না। কথামতো তাই করেছি। কিন্তু আবার বাধ সাধলো যৌতুকে।
যৌতুক শুধু সামাজিক ব্যধি বললে কম হবে। এটা এখন মরণ ব্যধি। একজন বাবা তার পিতৃত্ব জীবনকালে (৪৫-৬৫) বছর বয়সে এসে কন্যা বা পুত্রের বিবাহ দেন। আর এই বয়সে ঋণগ্রস্ত হতে হয়। কারণ কন্যার বিবাহ। এই বয়সে একজন বাবা কর্মক্ষমতাহীন হন ৬০ বছরে চাকরি হারিয়ে। চলেন পেনশনের টাকায়। আর যে বাবা শ্রমিক অথবা চাষি, তার ভিটেমাটি বিক্রি করে কন্যা সম্প্রদানের আয়োজন করেন, অনেকের এই এই সামর্থ্য না থাকলে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে টাকা জমিয়ে বর পক্ষকে ভিক্ষা দেন, সেই পরিশ্রম, গ্লানি, দিনের পর দিন একটা শার্ট পরে থাকা, একজোড়া জুতা বারবার সেলাই করা আর অনাহারে দিনযাপনের কনের বাবার টাকায় ছেলের বাড়িতে পাকা বাড়ি,চাষের জমি আর নগদ টাকার অহঙ্কার জমা হয়। এতে তাদের পৈশাচিক আনন্দ আর আভিজাত্য বোধ জন্ম নেয়।
এটা তো গেলো আামাদের কথা। উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো যেন যৌতুকের উসকানি দিচ্ছে রীতিমতো। সরকারি কর্মকর্তারাও পিছিয়ে নেই কোনো অংশে। একজন সরকারি কর্মকর্তার সর্বনিম্ন বাজারদাম ২০ লাখ টাকা। একটা অমানবিক প্রতিযোগিতায় নেমেছে বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলো। ৩য় শ্রেণী চাকরি করে ১০ লাখ পেলে আমার ছেলে ১ম শ্রেণীর, তাহলে নিচে ২০/২৫ লাখ লাগবেই। কে কত টাকায় মেয়ে দেবে, তার একটা লিস্ট রংপুর বিভাগের এক ক্যাডার ছেলের বাবা মুখস্ত শুনিয়েছেন আমি অবাক হইনি। কারণ উত্তরবঙ্গে সরকারি চাকরিজীবী ছেলে মানেই টাকা দিয়ে গরুটা কিনতে হবে। অবশ্য প্রাইভেট গরুর দামও চড়া।
এই গরু কেনায় আদৌ কনের সম্মান বাড়ে?একটু খানি বাড়ে যতক্ষণ যৌতুকের টাকা শেষ না হয়। শেষ হলেই ধরে ধরে আছাড় দেবে। তারপর আরও দিতে বলবে? ভুক্তভোগী মেয়েটি বাবার কথা ভাবতেই বাবার ‘বিশাল ঋণের বোঝা ‘ মনে করবে আর আত্মাগ্লানি নিয়ে পরিবারের নির্যাতন সহ্য করবে। বাবা-মায়ের সামর্থ্য না থাকলেও এই পথে কত পরিবার যে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে?তাই এই ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে আমাদেরই।
করোনা মহামারি সময়ও থেমে নেই নারীর প্রতি সহিংসতা। এ সময়কালে নারীনির্যাতন, বিশেষ করে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বেশি। ২০২০ সালে যৌতুকের কারণে পারিবারিক নির্যাতনের মারা গেছে ৩৬৭ নারী। নির্যাতনের শিকার ৯০জন আত্মহত্যা করেছে। অথচ যেখান ২০১৯ সালেই ভুক্তভোগী নারী ছিল ৪২৩জন। যা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। বছরে গড়ে ২২ জন নারী যৌতুকের কারণে মারা যাচ্ছে শুধু ঢাকায়। এছাড়া গ্রামের সালিশিতে হরহামেশাই নির্যাতনের শিকার হয়, যা পরিসংখ্যানে আসে না। দেশের আদালতে যেসব সালিশি হয় তার ৫০ শতাংশ যৌতুক নিরোধ আইনের মামলা।
UNDP এর পরিচালিত System of Dowry in Bangladesh গত ১০ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক বা মানসিক অথবা উভয় নির্যাতনের শিকার হয়। অর্থাৎ সাদা চোখে শুধু হিন্দু পরিবারগুলোর দিকে চোখে আঙুল দিলেই আর চলছে না। এ মরণব্যধি সমগ্র বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে আছে।
২০২০ লকডাউন সময়ে বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকের পাল্লা ভারী ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায়। তাই যৌতুক নিরোধ আইন কার্যকর প্রয়োগের সময় এসেছে এখন। লকডাউন পরবর্তী সময় এবং ২০২১, ২০২২ ও চলতি বছরও এর সংখ্যা মোটেও কমেনি। বরং দ্রব্যমূল্যের মতো যৌতুক ও বাল্যবিবাহ দুটোই বেড়েছে।
যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, সেখানে বাল্যবিবাহ অধিক। কিন্তু হতাশার কথা হলো শিক্ষার আলো পৌঁছালেও যৌতুক প্রবণতা ও বাল্যবিবাহ কোনোটাই যেন পিছু ছাড়ছে না। সরকারি তৃণমূল পর্যায়ে কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। অবশ্য সরষের মধ্যেই ভূত। তবু কিছু সত্যিকারে ভূত তাড়ানোর লোক তো আছেই সমাজে। ১৯২৯ সালে ভারতীয় বাল্যবিবাহ আইন এবং ১৯৬১ (সংশোধন-১৯৮৬) সালে পণপ্রথা আইন কতগুলো যুগ পেরিয়ে গেলেও আইনের কার্যকর প্রয়োগে ব্যর্থ। ভারতীয় আইন ১৯৮৬ অনুযায়ী ১০,০০০টাকা জরিমানা এবং ৬ বছরের জেল। অন্যদিকে বাংলাদেশের আইন একটু শক্তিশালী। বাংলাদেশে ‘যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮’-এর ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেউ যৌতুক দাবি করলে অনধিক পাঁচ ( ৫) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। এছাড়া, সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হওয়ার সময় ‘যৌতুক দেবো না, নেবো না’ কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়। তারপরও কেন বাজারে পণ্যের মতো দাম হাকিয়ে বেড়ায় এবং নির্লজ্জের মতো নিজেকে বিক্রয় করে?
হিন্দু মেয়েদের বাবার সম্পত্তি লাভের অধিকারী হওয়া যেমন যুগের চাহিদা, তেমনি পণ না দিয়ে বিবাহ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন, এটা শুধু যুগের নয়; বেঁচে থাকারও দাবি।
হৈমন্তী নয় শুধু যৌতুকের কাছে হার মানবে হাসিনা,নাসিমার জীবনও। এর জন্য প্রয়োজন ঘর থেকে ঘরে প্রতিটি মেয়ের অন্তরে আন্দোলনের বীজ রোপণ করা। এক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও এনজিওগুলোর সহায়তা নিয়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যৌতুকবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রতিটি স্কুলে সপ্তাহে একদিন সচেতনমূলক আলোচনার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। শিক্ষকদের নজরে রাখতে হবে কোনো শিক্ষার্থী যেন ঝরে না যায়। এজন্য পাঠ্যসূচিতে সচেতনতামূলক আলোচনা থাকা দরকার। গণমাধ্যমে প্রচার করে সর্বোপরি একটা যৌতুক এবং বাল্যবিবাহ রোধের গণআন্দোলন প্রয়োজন। যৌতুক একধরনের ভিক্ষাবৃত্তি। এর মাধ্যমে সম্মান নয় বরং নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন হয়। এ অভিশাপ থেকে কন্যাদের বাঁচাতে হবে শিগগিরই।