দীর্ঘ আশি বছরের জীবন নদীর বুকেই কেটে গেছে মঈনুFlorida state seminars jerseys custom football jerseys custom ohio state jersey oregon ducks jersey deuce vaughn jersey Iowa State Football Uniforms ohio state jersey deuce vaughn jersey custom football jerseys oregon ducks jersey deuce vaughn jersey brandon aiyuk jersey rowan university new jersey fsu jersey Iowa State Football Uniforms দ্দীনের। কত আর বয়স তখন; তের চৌদ্দই হবে, পেটের দায়ে বাসু মাঝির মাছ ধরার নৌকায় বৈঠা হাতে নেয়। তারপর একটা গোটা জীবন, আশি বছর কমdeuce vaughn jersey keyvone lee jersey miami hurricanes jersey oregon ducks jersey aiyuk jersey brock purdy jersey florida jersey brock bowers jersey brock purdy jersey Florida state seminars jerseys brock bowers jersey Ohio State Team Jersey custom made football jerseys detroit lions jersey,green bay packers jersey,eagles kelly green jersey,jersey san francisco 49ers custom football jerseys কথা তো নয়, এই নদীতেই কেটেছে। কত ঝড়-ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ দিন এসেছে আবার নিস্তরঙ্গ সোনালি রোদ্দুরের দিনও কম আসেনি। কিন্তু আজকের মত এমন অভিশপ্ত দুর্দিন মঈনুদ্দীনের জীবনে আসেনি। তাই সাঁঝ নামা হালকা আঁধারে মনের গহীন থেকে নদীর কাছেই শেষ আশ্রয় ভিক্ষা চায়। বয়সের ছোবলে কুঁচকে যাওয়া ঝুলে পড়া গাল বেয়ে কোটরাগত চোখে অশ্রুর প্লাবন নামে আর আসে কৈশোরের সেই দিনগুলো।tutobon.com stenyobyvaci.cz red-gricciplac.org saljofa.com saralilphoto.com truhlarstvibilek.cz red-gricciplac.org saljofa.com ribstol elan sevilenotocekici.com stenyobyvaci.cz saralilphoto.com sevilenotocekici.com teplakova suprava panska teplakova suprava panska
শ্রীরামকাঠী বন্দর থেকে মাইল দুই উজানে প্রমত্তা মধুমতী এবং বেলুয়া নদীর মোহনা। জায়গাটার নাম ভীমকাঠী। দুই স্রোতস্বিনীর মিলিত ধারা কালীগঙ্গা নাম ধরে দক্ষিণে গেছে। সময়টা শ্রাবণের শেষ অথবা ভাদ্রের প্রথম। বিরামহীন বর্ষা নেমেছিল সেদিন। নদীতে জাল ফেলে ভীমকাঠী খালের মোহনায় একটা বট গাছের শিকড়ে নৌকা বেঁধে দু’জন বিশ্রাম নিচ্ছিল। হোগলা পাতার জোংরা মাথায় দিয়ে বাসুমাঝি হুক্কা টানছিল। বৃষ্টি ধারার মধ্যে রাশি রাশি নীল ধোঁয়া কুন্ডলী পাঁকিয়ে ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে মঈনুদ্দীনের হুক্কা টানার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু কর্তা নায়ে থাকতে এসব কথা মনে আনতেও ভয় পায় সে। কখনো সখনো মঈনুদ্দীনের হা করে চেয়ে থাকা এবং ঘন ঘন ঢোক গেলার লোভাতুর ভঙ্গী দেখে বাসুমাঝি ছল-ছুতোয় ডাঙ্গায় ওঠেন। মঈনুদ্দীন এই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। হুক্কা থেকে কল্কেটা হাতে নিয়ে প্রাণপণ কষে গোটাকয়েক টান দিয়ে স্বস্থানে এসে কিচ্ছু না জানার ভঙ্গীতে বসে থাকে। বাসুমাঝি আচমকা এসে পড়লে অপ্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে তার অপরাধ প্রবণতার কৈফিয়ত দেয়। গোপনে হেসে বাসুমাঝি অন্য প্রসঙ্গে যায়। কিন্তু এই অঝোর বৃষ্টির মধ্যে আজ আর কর্তার ওঠার সম্ভাবনা নাই। এমন সময় স্টীমারের ভোঁ বেজে ওঠে মধুমতির বুকে। স্টীমার দেখায় মঈনুদ্দীনের দূর্ণিবার আকর্ষণ। দুই পাশে প্রকান্ড দুই চাকা ছপ্ ছপ্ করে জল কেটে একটা অনবদ্য তালে ঘোরে। সে তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকে। রোজ দেখে, তবু প্রতিদিনই নতুন মনে হয়। যতদূর চোখে পড়ে সে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওই যন্ত্রদানবটার মায়ায় পড়ে গেছে। একদিন যদি ভিতরে ঢুকে দেখতে পারত!
স্টীমার যাবার পরে নদীর দুই পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ওঠে। নায়ের গলুইয়ে বসে এই দোলা লাগাটাও দারুন উপভোগ করে সে। নায়ের দুলুনি থামতেই কর্তা বলেন- “জানো মঈনুদ্দীন, এই দেশটা নাকি হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে ভাগ হয়ে গেছে।” মঈনুদ্দীন দেশ ভাগের কথা কখনো শোনেনি আর ভাবেওনি। কিন্তু কর্তার উপর তার পরিপূর্ণ বিশ্বাস। তিনি গাঁয়ে রামযাত্রার পালাগানে পার্ট করেন, গ্রামের টোলে পড়েছেনও, অনেক খবরাখবর রাখেন। কর্তার কথা সে দৈববাণীর সমান মানে। তাই কিছু না বুঝলেও সে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে- “তাতে আমাদের কী।”
মরিচীকা চকিতে মিলিয়ে যায় যেমন মিলিয়ে গেছে স্বাধীনদেশে সম্মানজনক একটা সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্ন।
-আমাদেরই তো দুর্দিনরে বোকা! বৃটিশরা এই দেশটাকে হিন্দু-মুসলমানের অংশ হিসেবে ভাগ করে এই ক’দিন আগে তাদের দেশে ফিরে গেছে। আমাদের এই দেশ পড়েছে পাকিস্তানের ভাগে। এখানে হিন্দুরা থাকতে পারবেনা। আমাকেও এখান থেকে চলে যেতে হবে।
আজ হঠাৎ কর্তার কথায় অবিশ্বাস হতে থাকে মঈনুদ্দীনের। দেশ তো সবার; তা আবার হিন্দু-মুসলমানের অংশ হিসেবে ভাগ হয় নাকি? আর বৃটিশরা যদি করেও এদেশের মানুষ তা মানবে কেন ? সে কর্তার কাছে নির্বিকারভাবে বলে, ওসব বাজে কথা, দেশ আবার ভাগ হয় নাকি ?
যতই দিন গড়াতে থাকে ততই খবরটা জোর প্রচারিত হতে থাকে। সেদিন শ্রীরামকাঠী বন্দরে গিয়েও সবার মুখে এই কথাই শুনেছে মঈনুদ্দীন। শ্রীরামকাঠী রামায়ণের শ্রীরাম অথবা ভীমকাঠী মহাভারতের ভীমসেন আসেনি। কিন্তু কোন প্রাচীনকালে তাদের নাম ঠাঁই গেড়েছে এই জনপদে। তেমনি দেশ ভাগের প্রবল ধাক্কা এই অজপাড়াগাঁয়ে না লাগলেও মৃদু ঢেউ এসে আঘাত করেছে সবার মনে। তাই বিচিত্র দ্বন্দ্ব-শঙ্কায় কাল কাটতে থাকে সবার। মঈনুদ্দীনও সে তরঙ্গে দুলতে থাকে।
দু’দিন পর কর্তা গম্ভীরমুখে বন্দর থেকে ফিরে আসে। তার মুখ দেখে মঈনুদ্দীন ভাবনায় পড়ে যায়। কোন কথা বলতে সাহস পায়না। একসময় কর্তা নিজ থেকেই বলেন, মঈনুদ্দীন, আমাদের পাড়ার সবাই কালই হিন্দুস্তান চলে যাচ্ছি।
স্বরটা কেমন কাঁপা, ধরা গলা। মঈনুদ্দীনের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। হাঁটু গেড়ে কর্তার সামনে ধপ্ করে বসে পড়ে সে। বিস্মিত, হতাশ গলায় বলে, কেন যাবেন কর্তা ?
-মানুষের পাপের ফল মানুষই ভোগ করে। সভ্যতার বুকে হয়তোবা ক্ষত চিহ্ন থাকে, হয়তো থাকেনা। কিন্তু পাপ থেকে মানুষ সহজে মুক্তি পায়না। নোয়াখালীতে মুসলমানরা নির্বিচারে হিন্দুদের হত্যা করছে। কোলকাতা, পাঞ্জাব সর্বত্র একই ভয়ংকর অবস্থা। হিন্দু মারছে মুসলমান, মুসলমান মারছে হিন্দু। এই হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীবের কাজ। কী আর করব বল? দেশ মায়ের মত। তার কোল ছেড়ে কি পালিয়ে যাওয়া যায়? কিন্তু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে তো। তাই মাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি।
অনাথ মঈনুদ্দীন এবার কেঁদে ফেলে। সত্যিই যাবেন কর্তা? আমার অবস্থা কি হবে?
-কাঁদিস না। তুই সন্তানের মত। তোকে ছেড়ে যেতে মন চায়না। কিন্তু আমার যে আর অন্য উপায় নেই। এই জাল আর নৌকা তোকে দিয়ে গেলাম। সৎভাবে থাকলে এই দিয়ে তুই বেঁচে থাকতে পারবি। তবে একটা কথা মনে রাখিস, যতক্ষণ এই নায়ে থাকবি তোর চোখের সামনে কেউ বিপদে পড়লে জীবন বাজি রেখে তাকে সাহায্য করবি। মা গঙ্গা তোকে রক্ষা করবেন।
স্বগতোক্তির মত বিড় বিড় করে বলেন, ধর্ম ব্যক্তির শ্রদ্ধা-বিশ্বাসের ব্যাপার, ঈশ্বরোপলব্ধির গূঢ় পথ। তা নিয়ে যখন পলিটিক্সের ব্যবসা ফাঁদা হয়, তার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হয়না। জিন্নাহ্ এই যে বিষবৃক্ষ রোপন করলেন শতাব্দী ধরে আমাদের তার খেসারত দিতে হবে। মঈনুদ্দীনের মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে নেমে গেলেন কর্তা।
এসব মঈনুদ্দীনের সদ্য যৌবনের কথা। তারপর বাইশ তেইশ বছর কালীগঙ্গার বুকে কত প্লাবন নেমেছে আবার শান্ত হয়েছে। নদীর ভীষণ তরঙ্গের সাথে যুদ্ধ করে সে জীবনের বুনিয়াদ মজবুত করেছে। যৌবনের খেলাঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আমেনাকে। প্রেম-ভালবাসা, বিরহ-মিলনের মধ্যে দিয়ে সুতার জালে নদীটাকে বেঁধেছে বারে বারে আর সংসার মঈনুদ্দীনকে বেঁধেছে মায়া-মমতায়। আমেনার কোল জুড়ে সন্তান এসেছে চাঁদের মত ফুটফুটে। এরই মধ্যে দেশের আকাশে আবার দুর্যোগের ঘনঘটা। মঈনুদ্দীন এখন অনেক কিছু জানে-বোঝে, অনেক খোঁজ খবর রাখে। ধর্মের উস্কানি দিয়ে, লোভ দেখিয়ে যে পাকিস্তান পয়দা করেছিলেন জিন্নাহ তা শুধু লোক ভুলানো ভড়ং। বৃটিশদের থেকে সহস্রগুণ লোভ এবং শোষণযন্ত্র নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তার নগ্ন থাবা বসায়। শুরু হয় যুদ্ধ। মঈনুদ্দীনের বুকে দুরন্ত এক আবেগ বাসা বাঁধে। ধর্মের নামে ভন্ডামী আর জুলুমবাজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন জাগে মনে। একদিন সুযোগও এসে যায়।
রাতে জাল ফেলে নৌকায় শুয়েছিল সে। গভীর রাতে কয়েকজন যুবক এসে পার করে দিতে বলে। কর্তার শেষ কথাগুলো তার কানে বাজে। নৌকায় উঠিয়ে যুবকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা মুক্তিবাহিনী, স্বাধীনতা আরও কতসব কথা বলে। মঈনুদ্দীনের রক্তে দোলা লাগে। সে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করে, আমাকে নেবেন আপনাদের সাথে, দেশের জন্য আমিও যুদ্ধ করব।
মধ্যবয়সী গম্ভীর মত লোকটা, এদের দলপতি বলে মনে হয়, মঈনুদ্দীনকে কাছে বসিয়ে দরদভরা গলায় বলে, আমরা এই এলাকায় কাজ করব বলে নতুন এসেছি। এখন পর্যন্ত পথঘাট ঠিকমত চিনে উঠতে পারিনি। তুমি বরং এই কাজে আমাদের সহায়তা কর। যুদ্ধ মানে অস্ত্র হাতে শত্রু মারাই নয়। এই যে তুমি আমাদের পার করে দিচ্ছ এটাও যুদ্ধের অংশ। বরং প্রতিরাতে তুমি এই কাজটুকু করলে আমাদের থেকেও তোমার কাজের মূল্য বেশী।
মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে মঈনুদ্দীন খুশি চেপে রাখতে পারেনা। আমেনাকে এসে শেষ রাতে জাগিয়ে সব কথা জানায়। বলে, যতদিন যুদ্ধ চলে আমি বাড়িতে ঘুমাব না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাতে পার করে দিতে হবে। এটাই দেশের জন্য আমার যুদ্ধ।
এরপর দীর্ঘ সাতটি মাস মঈনুদ্দীন একরাতও বাড়িতে থাকেনি। এরই মধ্যে একদিন দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। এতদিন বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয়পাত্র এবং কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। এমন রাতও গেছে মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চিন্তে তার নৌকায় ঘুমিয়েছে, সে মাঝ নদীতে জালের দড়িতে নৌকা বেঁধে বিনিদ্র প্রহরা দিয়েছে। কর্তার কথা মন্ত্রের মত মনে মনে জপেছে, দেশ মায়ের মত।
একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ পৌঁছে দিতে ভোর রাতে পাশের গাঁয়ে যায়। আচমকা আক্রমণ শুরু হওয়ায় মঈনুদ্দীন পালাতে সময় পায়নি- একটা গুলি এসে লাগে তার বাম হাঁটুতে। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন চিকিৎসা আর আমেনার একান্ত শুশ্রষায় সে প্রাণশক্তি ফিরে পায় এক সময়। কিন্তু হাঁটুর কাছ থেকে বাম পাটা কেটে ফেলে নিষ্ঠুর ডাক্তার। দেশ যেদিন স্বাধীন হয় সেদিনও সে চলৎশক্তিহীন। দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দ উদযাপন করার পরিবর্তে হাসপাতালের দুর্গন্ধময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার দিন কাটে। তবু স্বাধীনতার খবরটা তার মনে এত আলোড়ন তোলে যে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও ক্রাচে ভর দিয়ে আমেনার হাত ধরে সে বাড়ী ফিরে আসে। সবাইকে ডেকে ডেকে সংবাদটা প্রচার করে। কেউ তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে এলে বুক ফুলিয়ে বলে, একটা পা গেছে তো কী হয়েছে, এই দেশ, আমাদের মা যে মুক্ত হয়েছে। তার সম্মান, সম্ভ্রম রক্ষা পেয়েছে।
স্বাধীন দেশে মঈনুদ্দীনের পা এবং যৌবন হারানোর পরে নতুন স্বপ্ন বুকে পথ চলা শুরু হয়। অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে পথটা অনতিক্রম্য হয়ে দাঁড়ায়। দেশের জন্য সবথেকে মূল্যবান, নিজের শরীরের একটা অংশ বিসর্জন দেবার পর যে আবেগ কাজ করেছিল তা ক্রমে মরে যায়। পঙ্গু মু্ক্তিযোদ্ধার যে সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্য ছিল রাষ্ট্র-সমাজ-স্বজনের কাছে তার বিপরীত অবস্থানে “নুলা মঈনুদ্দী” নামে সে অবজ্ঞার পরিচিতি পায়। পেটের দায়ে আত্মজকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে না পেরে মাছ ধরতে নিয়ে যায়। হাঁটুর কাটা জায়গাটা শুকিয়েছিল অনেক আগেই। এবার শুকাতে শুরু করে শরীর। তার থেকেও শঙ্কা ঘনায় মনে যখন নদীটা শুকিয়ে আসে। মধুমতির বুকের মধু দেখতে দেখতে ফুরিয়ে আসে। ইলিশের মত চঞ্চল গতিময়তাকে সে আর আকর্ষণ করতে পারেনা। জীর্ণ-শীর্ণ কলেবর নিয়ে নুলা মঈনুদ্দীনের মত অবাঞ্ছিত জীবন যাপন করতে থাকে মধুমতিও। মঈনুদ্দীন আজকাল প্রায়ই অতীত-স্বপ্নে বিভোর থাকে, দুই কুল ভেঙ্গে প্রবল উচ্ছ্বাসে ধেয়ে চলছে মধুমতি। তার বুকে দিগন্ত কাঁপিয়ে স্টীমারের ভোঁ বাজছে। কঙ্কালসার মঈনুদ্দীন আচমকা জেগে ওঠে স্টীমার দেখার জন্য। কিন্তু মরিচীকা চকিতে মিলিয়ে যায় যেমন মিলিয়ে গেছে স্বাধীনদেশে সম্মানজনক একটা সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্ন।
মঈনুদ্দীনের মনে ব্যাকুল প্রশ্ন জাগে, এই আঁধার কেটে কখন আলোক উজ্জ্বল শুদ্ধ ভোর আসবে! সেই মুহূর্ত কি নুলা মঈনুদ্দীন দেখে যেতে পারবে !
ইলিশের বড়ই আকাল দেখা দিয়েছে। আজকাল জালে যে মাছ পড়ে তা দিয়ে অন্নসংস্থান হয় না। কিন্তু অন্য কোন পথও তার জানা নাই। কৈশোর থেকে এই একটামাত্র কাজ সে করে আসছে। এছাড়া শক্তিহীন এই পঙ্গু শরীর নিয়ে আর কোন্ কাজটাই বা সে করতে পারবে ? জাল ফেলা শেষ হলে নৌকায় বসে বসে এইসব বিষণ্ন ভাবনা ভাবে। মঈনুদ্দীন আজকাল যেন দুঃখবাদী দার্শনিক হয়ে উঠেছে। ছেলের মুখে শুনেছে, আজকাল নাকি ইলিশ মাছ ধরায় সরকার নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। মাঝে মাঝে পুলিশ আসে। মঈনুদ্দীনকে না শুনিয়ে ছেলে তাদের সাথে কীসব কথা বলে কে জানে ! সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই কত লোক মাছধরা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। নদীতে মাছ না থাকলে ধরবেই বা কি ? মঈনুদ্দীনের কাছে মাছ ধরাটা একমাত্র কাজ নয় বরং নিঃসঙ্গ ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকার নেশাটা ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরার চেয়েও বেশি রঙিন, বেশি মোহনীয়।
ক’দিন ধরে ছেলেটার অসুখ। সংসার অচলপ্রায়। মঈনুদ্দীন জাল ফেলে বসে আছে। আগে জাল ফেলে বারে বারে স্রষ্টাকে ডাকত যাতে জাল ভরে রূপালী ইলিশ ওঠে। আজকাল স্রষ্টার কাছে এত ক্ষুদ্র চাওয়া চাইতে কেমন যেন লজ্জা করে- জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৃথিবীতে এত সুন্দরের সমারোহে কী করে শুধু পেট ভরার কথা বলা যায় ! কিন্তু সেদিন না চাইতেই জালে অনেক ইলিশ পড়ে। নৌকার পাটাতনের উপর বিশালকায় ইলিশের কানকো বেয়ে গাঢ় রক্তের ধারা নামে। মঈনুদ্দীন এই প্রথম লক্ষ্য করে দেখে, ইলিশগুলো অপূর্ব সুন্দর, তার প্রথম যৌবনে শরীরটার মত লাবণ্যময়। কিন্তু এসব ভাবনা ফুঁড়ে অসুস্থ ছেলেটার কথা মনে আসে। তাকে ডাক্তারের কাছে নেবার ব্যবস্থা আজ হয়তো বা হয়ে যাবে। জাল গুটিয়ে শ্রীরামকাঠী বন্দরের দিকে নৌকা চালায়। হঠাৎ ইঞ্জিন চালিত একটা ছোট নৌযান এসে তার নৌকার পাশে থামে। যুবক এক পুলিশ অফিসার লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করে, এই তোর ছেলে কোথায়, এ মাসের টাকা দেয়নি কেন ?
অধস্তনদের বলে, শালার জাল ট্রলারে তোল। শালাদের এত সুযোগ দিচ্ছি তবু ঠিকমত মাসোহারা দেবেনা, ওদের জাল পুড়িয়ে দেব।
বলতে বলতে দু’জন পুলিশ এসে জাল গুটাতে শুরু করে। নাতির বয়সী একজন অফিসারের মুখে কদর্য ব্যবহার শুনে হতবিহ্বল মঈনুদ্দীন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তার মুখে ভাষা সরেনা। পুলিশ দু’জন জাল তুলতে গেলে মঈনুদ্দীন সম্বিত ফিরে পায়। হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে জালের দড়িটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে। তার সারা জীবনের একমাত্র সম্বল এই জালটা নিয়ে পুড়িয়ে দিলে বাকী জীবনে আর একগাছি জাল তৈরি তার সাধ্যে কুলোবেনা। তার অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। এর পরের মুহুর্তে যা ঘটল তা যদি মঈনুদ্দীন কল্পনায়ও ভাবতে পারত তবে যৌবনের গুলিবিদ্ধ দিনটায় মধুমতিতে ঝাঁপ দিয়ে শহিদ হত এই ভাষাতীত ঘৃণার জীবন দেখতে হত না। পুলিশ অফিসার লাথি দিয়ে বয়সের ভারে ন্যূব্জ বিকলাঙ্গ শরীরটা নৌকার পাটাতনের ওপর ফেলে। নৌকার সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে মাথাটা ঠুকে যায়। অলক্ষ্যে একটা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে মুখ থেকে। ইঞ্জিন চালক ছুটে এসে মঈনুদ্দীনকে তুলতে তুলতে বলে, করেন কি স্যার! পঙ্গু মানুষ, এই বয়সে কী করে সংসার চালাবে?
স্বাধীন দেশে, যে দেশটাকে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যৌবন-প্রিয়জন হারিয়ে মঈনুদ্দীনরা অর্জন করেছিল, সেই দেশের আইনের রক্ষক- পুলিশ অফিসারের মাসোহারা না পাওয়ার ক্রোধ কোনমতেই প্রশমিত হয়না। সরকারের নির্দেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিষিদ্ধ ইলিশ ধরার সুযোগ করে দিচ্ছে- বিনিময়ে সে মাসোহারা পাবেনা, এ কোন দুর্নীতি! এমন অরাজকতা মেনে নিলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে ! তবু তার মনে দয়া হয়। ইঞ্জিন চালককে বলে, নুলাটার জাল দিয়ে বলে দে। দু’এক দিনের মধ্যে ওর ছেলে যেন আমার সাথে দেখা করে। আর দেখ নৌকায় মাছ আছে কি না। ভাল করে দেখিস, ওদের বিশ্বাস নেই, লুকিয়ে রাখতে পারে।
জীবনের চরমতম অপমান-অসম্মানের মধ্যেও বিকৃত হাসি পায় মঈনুদ্দীনের, নিজের রক্ত জল করা পরিশ্রমে ধরা মাছ সে লুকিয়ে রাখবে! আরও একটা বিস্ময় তার চেতনাকে দোলায়িত করে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে তার ছেলে বাপকে না জানিয়ে পুলিশকে মাসোহারা দেয় ! প্রয়োজনে মাছধরা ছেড়ে সে ভিক্ষা করবে। কিন্তু ঘুষ দিয়ে আজীবনের সঙ্গী এই নদীর বুকে মাছ ধরবে! কর্তা যে বলেছিলেন, জিন্নাহর রোপণ করা এই বিষবৃক্ষের খেসারত আমাদের শতাব্দী ধরে দিতে হবে। তবে কি বিষবৃক্ষে এখন ফুল-ফলের সমারোহ এসেছে! তাই আইনের উর্দি পরে পিতামহর বয়সী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি মারতে বিবেক তাকে কশাঘাত করে না! মঈনুদ্দীনের চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসে। মৃতপ্রায় মধুমতির কাছে অন্তরের আকুল বাসনা জানায়, তোমার বুকে ঠাঁই দাও এবার, আর যে পারি না!
দিন গড়িয়ে টিপ টিপ বৃষ্টির সাথে আঁধার নামে। মঈনুদ্দীনের মনে ব্যাকুল প্রশ্ন জাগে, এই আঁধার কেটে কখন আলোক উজ্জ্বল শুদ্ধ ভোর আসবে! সেই মুহূর্ত কি নুলা মঈনুদ্দীন দেখে যেতে পারবে !