১.
‘আপনি কি আমাকে কিছুটা সময় দেবেন, স্যার? খুব সমস্যায় আছি আমি, আর সহ্য করতে পারছি না। একটু সাহায্য করেন আমাকে প্লিজ…’কাতর কন্ঠে অনুনয় করলোdeuce vaughn jersey deuce vaughn jersey fsu jersey penn state jersey OSU Jerseys Florida state seminars jerseys OSU Jerseys johnny manziel jersey custom ohio state jersey asu football jersey oregon ducks jersey College Football Jerseys johnny manziel jersey custom made football jerseys detroit lions jersey,green bay packers jersey,eagles kelly green jersey,jersey san francisco 49ers অরুণিমা।
হতভম্ব মুরশীদ স্যার তার সামনে বসা। কী বিষয়ে কী কথা হচ্ছে এ মুহূOSU Jerseys justin jefferson lsu jersey deuce vaughn jersey penn state jersey Florida state seminars jerseys florida state football jersey deuce vaughn jersey custom ohio state jersey Ohio State Team Jersey justin jefferson lsu jersey Iowa State Football Uniforms fsu jersey detroit lions jersey,green bay packers jersey,eagles kelly green jersey,jersey san francisco 49ers keyvone lee jersey colleges in new jersey র্তে তার মাথায় কিছুই আসছে না। যতটা সম্ভব রাগ নিয়ন্ত্রণ করে তিনি বললেন, ‘আপা, আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর এটা কি কথা বলার সময় হলো? ব্রেকের পরেই আমার প্রেজেন্টেশন, আই নিড টু গেট প্রিপেয়ারড’।
‘স্যার, একটু বুঝেন। আমি কিছুই চাই না আপনার কাছে। আপনি আমাকে একটু সময় দেন। আমার অস্থিরতা কমিয়ে দেন। আমি বের হয়ে আসবো কথা দিচ্ছি,’হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অরুণিমা, তার গালে লালচে আভা, ঠোঁট কাঁপছে তির তির।
‘কোথা থেকে বের হবেন আপনি? প্লিজ বি ম্যাচিওর এন্ড এক্সপ্লেইন ক্লিয়ারলি’, অসহিষ্ণু কন্ঠ মুরশীদ স্যারের।
‘আমি…আমি খুব পছন্দ করি আপনাকে’, যতটা সম্ভব স্থির হয়ে জবাব দিলো অরুণিমা।beckmann 12l toploisir.com modré sandály na podpatku villapalmeraie.com sevilenotocekici.com vm 1986 trøje saralilphoto.com sevilenotocekici.com toploisir.com sevilenotocekici.com sevilenotocekici.com saralilphoto.com tomnanclachwindfarm.co.uk tomnanclachwindfarm.co.uk wiener-bronzen.com
‘হ্যাঁ, তো…কী করব আমি?’স্বপ্রশ্ন চোখে তাকালেন অরুণিমার দিকে।
‘আপনি বুঝতে পারেননি…আমি আপনাকে…’
‘আপা, হয় আপনার মাথার ঠিক নাই নয়ত আমি টেনশনে উল্টো পালটা শুনছি। আমাকে কি মাফ করা যায় না এখনকার মতো?’
সেই মুহূর্তে হাসান ক্যাফেতে ঢুকে মুরশীদ স্যারকে খবর দিল, ম্যাডাম আপনাকে খুঁজেন স্যার।
‘এক্সকিউজ মি…’বলে মুরশীদ স্যার উঠে পড়লেন। চায়ের কাপে একটা চুমুকও না দিয়ে। একটু খারাপ লাগলো অরুণিমার। ভদ্রলোকের একটু পরেই গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন। এক কাপ চা তো খাওয়া উচিত ছিল। বেচারাকে অস্বস্তির মাঝে ফেলা হলো। যদিও মুরশীদ স্যারের ছোট ছোট এসব কার্টসি তার খুব ভালো লাগে। ভদ্রলোক রেগে গেছেন এটা স্পষ্ট। কিন্তু ভদ্রতা করে এক্সকিউজ মি বলে তবেই উঠলেন তিনি।
অরুণিমা দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো। ভাল লাগছে না কিছু। তার ভাবনামতো কিছুই হয় নি। সে ভেবেছিলো মুরশীদ স্যার দু একটা কোমল কথা অন্তত বলবেন। এই যন্ত্রণা কিছুতেই আর সে নিতে পারছে না। গত এক মাসের উপরে সে শুধু ভাবছেই। কীভাবে কী করা উচিত কিছুই আসছে না মাথায়। সে জানে না কেনই বা হঠাৎ এমনভাবে প্রেমে পড়ে গেলো। সে বয়স বা পরিস্থিতি কোনোটাই তো তার নেই। এমন না সে এই অফিসে নতুন। গত দুই বছর সে দেখছে মুরশীদ স্যারকে। এবং প্রথম দিকে সে মোটামুটি অপছন্দই করতো মানুষটাকে। কথা বার্তা অতি সাজানো আর মেকি মনে হতো। অবশ্য উনার সাথে সরাসরি কোনো কাজও ছিলো না তার। ফলে মানুষটাকে চেনার সুযোগও তো হয় নি। নতুন প্রজেক্টের এই কাজটা করতে গিয়েই ঝামেলা বাঁধলো। এখন শুধু সে জানে মুরশীদ স্যার কিছুটা সময় তার সামনে বসে থাকলেই তার আর কিছু চাওয়ার নেই।
মাইক্রফোনে কেউ কিছু বলছে শোনা গেলো। অরুণিমা তড়িঘড়ি কনফারেন্স রুমের দিকে পা বাড়ালো। স্যারের নাম ঘোষণা চলছে। উনি পোডিয়ামে দাঁড়ানো মাত্র একটা হার্টবিট মিস করলো অরুণিমা।
স্বভাবসুলভ হাসিমুখে সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে শুরু করলেন তিনি। একটু আগে বলা অরুণিমার কথাগুলো কোনো প্রভাবই ফেলেনি যেন তার ওপর। কী সাবলীল উপস্থাপনা। অরুণিমা বার বার চাইলো স্যার কোথাও একটু হলেও ভুল করুক। কথা বলার মাঝে কিছুক্ষণ আগে তার মুখোমুখি হবার স্মৃতিটুকু মনে করুক। আবার, অরুণিমা এও চায়, স্যারের প্রেজেন্টেশন যেন সবার চেয়ে ভালো হয়। কী অদ্ভুত বৈপরিত্য।
স্যারের উপস্থাপনা শেষ। এবার প্রশ্ন নেবার পালা। অরুণিমা তৈরি হলো মনে মনে। যদিও সে কিছুই শোনেনি, কিন্তু তার একটা প্রশ্ন আছে স্যারের কাছে।
২.
মুরশীদ স্যার মনে হয় এমন কিছুর জন্য তৈরি ছিলেন। তিনি সরাসরি তাকালেন অরুণিমার দিকে। সে মুহূর্তে অরুণিমার মনে হলো সময় থমকে গেছে। আর কেউ নেই কোথাও, শুধু সে আর মুরশীদ স্যার। অরুণিমার চোখে তাকিয়েই স্যার বললেন, ‘এতক্ষণের প্রেজেন্টেশনের উপর প্রশ্ন নেবেন এই অর্গানাইজেশনের ই.ডি. ফারহানা হক’।
অরুণিমা হতাশ চোখে তাকালো। ম্যাডামের কাছে তার তো কোনো প্রশ্ন নেই!তার সব প্রশ্ন মুরশীদ স্যারের কাছে। আর কারো কাছে তার কিছু জানার নেই।
পরদিন অফিসে গেলো না অরুণিমা। ছুটিও নিলো না। আবীরকে নিজ হাতে রেডি করে স্কুলে পাঠালো। পুরো বাসাটা গোছালো। একটা সিনেমাও দেখে ফেললো। বিকেলে আবীর আর পলাশকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে এলো। শুধু সারাদিনের সব কাজের মাঝে থেকে থেকে অসংখ্যবার মোবাইল চেক করলো। না, মুরশীদ স্যারের কোনো ফোন বা মেসেজ নেই। অথচ তিনি তার রিপোর্টিং সিনিয়র।
সারাদিন স্বাভাবিক থাকলেও অরুণিমা টের পেলো সে আসলে স্বাভাবিক নেই। তার পুরো জগত এলোমেলো হয়ে গেছে। সারাটা দিন সে শুধুই মুরশীদ স্যারের সাথে ছিলো। কি আশ্চর্য!
পরের দিনও অফিস না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো অরুণিমা। সকালবেলার সব রুটিন কাজ সেরে যখন পেপারটা নিয়ে বসবে, তখনই ফোনটা এলো। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটার দিকে তাকিয়ে তার হাত পা অবশ হয়ে আসলো। মনে হলো যেন কয়েক যুগ পরে ফোনটা হাতে নিলো সে।
পরিচিত আর আকাংক্ষিত কন্ঠস্বর বলে উঠলো, ‘আপা, আমার রুমে আসবেন একবার? ইন্টারকমের কী হয়েছে জানি না, কোনো আওয়াজ নেই।‘
‘স্যার…মানে… আমি তো অফিসে যাই নি।‘
‘যান নি? আপনি কি ছুটিতে নাকি?’
‘আমাকে একটু সময় দেন, আসছি আমি।‘
কিভাবে রেডি হয়ে অফিস পর্যন্ত পৌঁছালো কিচ্ছু জানে না অরুণিমা। তড়িঘড়ি মুরশীদ স্যারের রুমে গিয়ে তাকে পেলো না। হতাশ অরুণিমা নিজের ডেস্কে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মুরশীদ স্যারের পাঁচটা মিসড কল। আর একটা মেসেজ,
Pls take your time, I need to leave. Go through the proposal, we need to submit the draft by tomorrow. Best, Murshid.
৩.
আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে
…
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,
তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে॥
বিজয় সরণীর সিগন্যালের লাল বাতি সবুজ হয়ে আবার লাল হয়েছে, কোনো গাড়ি সবুজ সঙ্কেত পায় নি এখনও। মুরশীদ স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে অন্যমনে ছুটির আমন্ত্রণের কথা শুনছে। কেন যে তড়িঘড়ি অফিস থেকে বের হয়ে এলো সে জানে না। হাসি পেয়ে গেলো তার। পালিয়ে বেড়াচ্ছো? নিজেকেই ধমকে ওঠে। এ প্রগলভতা মানায় কি তাকে?
মুরশীদ অরুণিমার বদলে যাওয়া খেয়াল করেছে আগেই। অরুণিমাকে সেও খুবই পছন্দ করে। খুব আপনার মানুষের মতো আচরণ মেয়েটার। কিছুটা ছেলেমানুষও। আবার নির্দ্বিধায় বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। তার প্রতি ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি হয়েছে আগেই। কিন্তু এই অনুভূতিকে কোন রূপ দিতে হবে তা কখনো মনে হয়নি তার। কতরকম ভাবেই তো কত মানুষকে ভালো লাগে। সব অনুভূতি একই পাল্লায় ফেলে মাপতে চাইলে কী চলবে?
আর বিষয়টাকে বেশি প্রশ্রয় দিতেও চায়নি সে। নারী কলিগদের জড়িয়ে কিছু রটনা রয়েছে তার নামেও। যদিও মুরশীদ তার জীবনে কোন নারীকে অসম্মান করে কথা বলেনি কোনদিন। তাছাড়া ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কাজ করে বলে ছোট বড় অনেক কিছুই মানতে হয় তাদের। তবু রটনা থামাতে পারেনি সে। চেষ্টাও অবশ্য করেনি। মুরশীদ চায় না অরুণিমাকে জড়িয়ে কোন নতুন কোন গল্প তৈরি হোক অফিসে। অন্তত অরুণিমাকে অসম্মানের মাঝে ফেলতে সায় নেই তার।
তবে অরুণিমার সাহচর্য তার ভালো লাগে। এই শান্ত অথচ ছটফটে মেয়েটার সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে তারও ইচ্ছে করে। অরুণিমা তাকে শৈশবে নিয়ে যায়, যে জীবনে কোন দায়িত্বের বোঝা নেই, ক্লান্তি নেই। ছাত্র বয়সের মতো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।
ছেলেবেলায় লুকিয়ে ‘সোনালী দুঃখ’ পড়েছিলো সে। একবার। বারবার। কোন বিষয় তাকে টেনেছিলো আজও পরিষ্কার নয় তার কাছে। সুনীলের লেখনী, সোনালীর রূপের বর্ণনা নাকি ত্রিস্তান-সোনালীর মিলনগাঁথা, কিসের আকর্ষণ তার কাছে বেশি ছিলো জানে না সে। লুকিয়ে পড়া বই নিষিদ্ধের মতোই তো ছিলো তার কাছে। নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ তার বরাবরই প্রবল। অরুণিমাও কি নিষিদ্ধের খাতায়? কিন্তু তার কেন উত্তেজনা নেই? কেনই বা এত বিষন্ন লাগছে? কেন মনে হচ্ছে সে বড় ক্লান্ত আজ? কেউ কি সত্যি সত্যি নিমন্ত্রণ জানাবে ছুটির?
৪.
‘আপনার ফোন কাল সারাদিন বন্ধ ছিলো?’ অরুণিমার গলায় অভিযোগ।
‘সারাদিন না, দুপুরের পর থেকে’ না তাকিয়ে জবাব দিলেন তাকে মুরশীদ স্যার।
ব্যস, আর কারো কোনো কথা নেই। অরুণিমা দুই বার অকারণেই শাড়ীর আঁচল ঠিক করলো, স্যার তাকালেন না। ‘আমি জানি আপনার কালো শাড়ী পছন্দ’ মনে মনে বলল অরুণিমা, তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। সে বুঝতে পারছে না, মানুষটা কেনো এড়িয়ে চলছে তাকে!
‘অরুণিমা’…অরুণিমা চমকে তাকালো। নাম ধরে খুব কমই তাকে ডাকেন স্যার। ‘আমাদের প্রপোজাল আজ সাবমিট করার কথা’।
‘জ্বী, আপনি বলেছিলেন কাল’, অরুণিমা স্থির চোখে দেখছে, মনিটরের দিকে তাকিয়ে কথা বলা মানুষটাকে।
‘১২টা থেকে মিটিং। আপনি শামীমকে নিয়ে চলে যান, শামীমকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি, ছোট একটা প্রেজেন্টেশন দেবেন। ইনোভেশনের দিকগুলো হাইলাইট করবেন। এই তো।’
‘শামীম তো যেতে পারবে না স্যার’ অরুণিমা হাসি চেপে জানালো। ‘ওর বাসা থেকে জরুরী কল এসেছে, আমাকে বলেই চলে গেলো’।
‘এখন?’ এতক্ষণে মুখ তুললেন তিনি, দৃষ্টিতে হতাশা।
‘উপায় নেই স্যার, আপনাকে আর আমাকেই যেতে হবে। আমি ম্যাডামের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু আপনি ঠিক আছেন তো? শরীর খারাপ করেনি তো আপনার?’ গলায় উৎকন্ঠা আনার চেষ্টা তার।
‘আপনি তৈরি হয়ে নিন তবে, গাড়ি রিকুইজিশন দিয়েছেন?’
‘পাওয়া গেলো না স্যার, ম্যাডাম শামীমকে গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন। আপনারটাই নিতে হবে’।
‘আমিও তাই ভেবেছিলাম, চলুন যাওয়া যাক তাহলে’।
৫.
‘স্যার, আমার একটা স্বীকারোক্তি ছিলো, বলবো?’
‘বলেন।’
‘ভয়ে না নির্ভয়ে?’
‘আপনি কি বরাবর এত কথা বলেন, নাকি আজ স্পেশালি বলছেন?’ গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে প্রশ্ন মুরশীদ স্যারের।
অরুণিমা হাঁটু মুড়ে সিটের উপর পা তুলে হাসিমুখে মুরশীদ স্যারের দিকে ঘুরে বসলো, ‘আপনি আজ কিছু বলেই আমার মন খারাপ করে দিতে পারবেন না।‘
‘সিট বেল্ট বেঁধে বসুন, না হলে আমি চালাবো না’ মুখ শক্ত করে বললেন মুরশীদ স্যার।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, বসলাম। কিন্তু কথাটা কি বলবো?’
‘আমি নিষেধ করলে আপনি বলবেন না মনে হচ্ছে?’
‘তা নয়, আসলে শামীমকে আমি আটকেছি। শুধু আপনার সাথে এভাবে যাওয়ার জন্য। আমার কথায় ও বানিয়ে বানিয়ে ম্যাডামকে বলেছে। এও বলেছে, তুই কি আমার চাকরিটা খাবি, হি হি’।
মুরশীদ স্যার একটা গাড়িকে ওভারটেক করলেন। প্রয়োজন ছিলো না। অরুণিমা অত লক্ষ্য করলো না, নিজের মনে বলতে লাগলো, ‘আপনার পাশে বসে এভাবে যাবো কোনোদিন কল্পনাও করিনি। আমার যে কী ভালো লাগছে।‘
হঠাৎ কী হলো মুরশীদ স্যারের, আগারগাঁ থেকে মিরপুর রোডে না গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দিলেন উত্তরার দিকে। বনানী পর্যন্ত একটানা চললো দুজন। অরুণিমা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না, কোথায় যাচ্ছে তারা? এবার অবশ্য সিগন্যালে দাঁড়াতেই হলো। হ্যান্ডব্রেকে চাপ দিয়ে অরুণিমার দিকে তাকালেন মুরশীদ স্যার। আর অরুণিমার খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এবার বলেন’।
এই পরিস্থিতি অরুণিমা আশংকা করেনি। এত কাছে মুরশীদ স্যার, তার নড়াচড়ার উপায় নেই। আমতা আমতা করে কোনরকমে বলে ওঠে, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে মুরশীদ স্যার বললেন, ‘প্রেমিক পুরুষের সাথে কোথাও যেতে তো আপত্তি থাকার কথা নয়’।
অরুণিমা দৃষ্টি সোজা রেখে বললো, ‘সোজাসুজি বিছানায় যাবার প্রস্তাব দেওয়ার মতো সস্তা প্রেমিক পুরুষ আপনাকে আমি মনে করিনা’।
একটু চমকে সোজা হলেন মুরশীদ স্যার। কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন মনে হলো। দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘স্যরি, মিটিংটা মিস করেছি মনে হয়, লেটস ট্রাই, যদি পৌছানো যায়। আপনি একটু জানান কেন আমাদের দেরি হচ্ছে’।
চেপে রাখা নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হলো অরুণিমা। নিজের উপর খুব রাগ হলো তার। সে কি মানুষটার ইমোশন নিয়ে খেলছে? এ দিকটা তো তার ভাবা হয় নি। মানুষটাকে এরকম নিয়ন্ত্রণহীন আগে দেখেনি সে। কী কষ্ট তার?
৬.
বাসার গলির মুখেই অনেক মানুষের ভিড়। জায়গাটাতে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ। টার্ন নেবার মুখে বুকটা কেঁপে ওঠে মুরশীদের। বাসায় কোন বিপদ হলো না তো! তাদের দারোয়ানকেও ভিড়ের মাঝে দেখা গেলো। স্যারের গাড়ি দেখে এগিয়ে এসেছে। গ্লাস নামিয়ে মুখ বের করলেন তিনি, ‘কি ঘটনা রুহুল?’
‘ট্রান্সফরমার বাস্ট করছে স্যার, কারেন অফ’ জানায় রুহুল। চেপে রাখা নিঃশ্বাসফেলে গাড়িটা গ্যারেজে ঢোকান তিনি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হবে পাঁচতলায়। বীথি কি আছে বাসায়? নিচে তো জিজ্ঞাসা করা হলো না। নিজের চাবি দিয়েই দরজা খুললেন তিনি। বসার ঘরে কেউ নেই। ভেতরের ঘর থেকে গানের আওয়াজ আসছে। নতুন কারাওকে মাইক্রোফোন এসেছে বাসায়। মা-মেয়ে দিন-রাত সঙ্গীতচর্চায় আছে। খাটের সব বালিশ জড়ো করে তার উপর বসেছে মেয়ে। গান গাইছে মাইক্রোফোনে। আর মা ভিডিও করছে।
‘বাবাআআ, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে একটা…’ বলেই মেয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। স্ত্রীর দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। ‘আমি বলব না, সারপ্রাইজ তো সারপ্রাইজই’ স্ত্রীর হাসিমুখের উত্তর।
চাবিটা রাখতে রাখতে বললেন, ‘চলো আজ বাইরে কোথাও যাই, ইলেক্ট্রিসিটি থাকবেনা বলে অনেকক্ষণ’।
‘তাই নাকি? জানি না তো! কোথায় যাবে?’ বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেলো বীথি। মেয়েকে বাইরে যাবার কথা বলতে বোধহয়।
বীথি এরকমই। কোনো কিছুর জন্যই অপেক্ষা করে না। বীথির সাথে তার সম্পর্কটা ভাবে মাঝে মাঝে মুরশীদ। তার পেশাগত জীবনটা যতটা চ্যালেঞ্জিং পারিবারিক জীবন ততটাই শান্ত। মুরশীদ নিজেই নিজের দুই অবস্থান মেলাতে পারে না। বীথির সাথে তার বিয়ে বাল্যবিবাহই বলা চলে। বাবাদের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো। সেই সূত্রে দুই পরিবারেরও। মায়েরা পুতুল খেলার মতো তাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো মুরশীদ তখন। বীথি কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। বিয়ের পরে দুজনের কেউই বাড়তি টান অনুভব করেনি। বাল্যসখা হিসেবে যেমন সম্পর্ক ছিলো, বিয়ের বন্ধনও তেমন পাল্টাতে পারেনি তাদের।
একসাথে থাকা শুরু আরো পরে। তখন থেকেই ধীরে ধীরে চেনার শুরু বীথিকে। বীথির মধ্যে একটা সহজ মন ছিলো। প্রথম জীবনে খুব উদযাপন করতো তারা। বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি, আড্ডা। বীথিও তার বন্ধুদের সাথে মিশে গিয়েছিলো। তার যেন নিজের কোন কিছু নেই, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা-ভালোলাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে।
ধীরে ধীরে নিজেদের জন্য সময় কমতে থাকে। বন্ধুদের আড্ডাও কমে আসে। পরিবারে নতুন অতিথি আসে। সময় দ্রুতলয়ে চলতে থাকে। সে লয়ে ছেদ পড়ে একসময়। বীথির ক্যান্সার ধরা পড়ে। শুরু হয় দুজনের যুদ্ধ। বীথি অনেক আগেই মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলো মুরশীদকে। সে চায়নি নিজের যুদ্ধে আর কাউকে জড়াতে। মুরশীদ হাল ছাড়েনি। একটা বছর স্ত্রীর পাশে পাশে লড়াই করে গেছে। মেয়েকে নানা বাড়ি রেখে দিয়েছিলো। দুজনার দিন-রাত বলে কিছু ছিলো না। কখনো বাংলাদেশ কখনো ভারত, যাওয়া আসার মধ্যে থাকত তারা। বীথি চাকরিটাও করতে পারেনি। বীথির যে কষ্ট মুরশীদ তখন দেখেছে, শরীরের-মনের, সে সময়েই প্রতিজ্ঞা করেছিলো বেঁচে থাকলে আর কোন কষ্ট তাকে পেতে দেবে না।
বীথি বেঁচে গেলো, কিন্তু কেমন যেন উদাসী হয়ে। জীবনের প্রতি সব মোহ মুছে দিয়ে। মুরশীদ চেষ্টা করে গেছে অবিরত তার প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য। কিন্তু ততদিনে কোথায় একটুখানি দুরত্ব এসে গেছে। নো-ম্যানস ল্যান্ড। দুজনের কেউই আর পার হতে পারেনি। চায়ওনি। এটুকু কী শূন্যতা তার? বীথিরও কি লাগে এমন? এই শূন্যতার জন্যই কি এড়িয়ে চলছে অরুণিমাকে?
৭.
অফিসের ডাইনিং-এ বসে অরুণিমা কান্না চাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটু আগে ইউনিট মিটিঙে তার ওপর দিয়ে মোটামুটি ঝড় বয়ে গেছে। সেদিন সময়মত প্রপোজাল নিয়ে তারা পৌঁছায় নি। মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তারা রিঅ্যাক্ট করেছেন। মুরশীদ স্যারের পরিচিতি থাকার কারণে সেদিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গিয়েছিলো। যদিও উনি সেদিন তেমন কিছু বলেননি। অরুণিমাই সব সামাল দিয়েছিলো। এমনকি মুরশীদ স্যারকেও।
গাড়ি ঘোরানোর পর থেকে অস্বাভাবিক চুপ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ সেরে অরুণিমা তাই অনুরোধ করেছিলো কোথাও বসে এককাপ কফি খাবার জন্য। মুরশীদ স্যার কোন আপত্তি ছাড়াই রাজী হয়েছিলেন। তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন খুব সুন্দর একটা ক্যাফেতে। সেই বিকেলটা খুব ভালো কেটেছিলো অরুণিমার। উনার পাশে পাশে থাকতেই অদ্ভুত ভালো লাগছিলো।
প্রথমে তাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। অরুণিমা নিজের স্বভাবসুলভ সরলতায় তাকে সহজ করে নিয়ে এসেছিলো। অনেক কথাও বলেছিলেন। তার বাল্যবিয়ের কথা, স্ত্রী-বাচ্চার কথা, ইতালিতে যখন পড়তে গিয়েছিলেন সে সময়ের কথাও।
সেদিন অরুণিমা বুঝেছিলো ভদ্রলোক ভালোই কথাবার্তা বলতে পারেন। আবৃত্তিও পারেন মোটামুটি। অযথাই সারাক্ষণ চোখে মুখে গাম্ভীর্্য এঁটে রাখেন। অথচ হাসিমুখে তাকে কতো যে ভালো দেখায়। কথায় কথায় অনেকখানি সহজ হয়েছিলো দুজনই। মোবাইলে দেখে দেখে ‘মেঘবালিকা’ থেকে আবৃত্তি করেছিলো একসাথে। আবৃত্তি শেষে হঠাৎ হাত তালির শব্দে চমকে চারপাশে তাকিয়ে দেখে ক্যাফেতে উপস্থিত মানুষজন তাদের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছে, আবৃত্তি শুনে।
অরুণিমাকে অবাক করে দিয়ে আরো একটা কাজ করেছিলেন সেদিন। তারপর নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে অরুণিমার কপালে এসে পড়া চুল হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্পর্শ অরুণিমা আজীবন মনে রাখবে। মুরশীদ স্যার লজ্জা পেয়ে শুধু শুধুই কফিতে দু চামচ চিনি দিয়ে নাড়া শুরু করেছিলেন। অরুণিমা জোর করে তার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলেছিলো, ‘আপনি এটা তো আর খেতে পারবেন না, আমারটা নিন’। মুরশীদ স্যারের তখনকার নিরুপায় হাসিটাও তার সারাজীবন মনে থাকবে।
সেদিনের মুরশীদ স্যারের সাথের আজকের স্যারকে সে মেলাতে পারছে না কোনোভাবেই। ফারহানা ম্যাডাম যেভাবে তার ওপর চড়াও হলেন, মুরশীদ স্যার পুরোটা সময় একটা কথাও বললেন না তার পক্ষে। প্রথমে তো শামীমকে ঝাড়া শুরু হলো। শামীমকে বাঁচাতে যেই অরুণিমা কথা বলা শুরু করেছে, আর পায় কে। তার কোথায় কোথায় কী কী গাফিলতি ছিলো একতরফা বলতে শুরু করলেন ম্যাডাম। উনি যেন তালিকা করেই নিয়ে এসেছেন! এই অফিসে মুরশীদ স্যার না থাকলে সে তখনই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতো।
বকাঝকার সময়ে সে একবারও মুরশীদ স্যারের দিক থেকে চোখ সরায়নি। ভদ্রলোক একমনে মোবাইল টেপাটেপি করেছেন, কোন কথা তার কানে গেছে কিনা বোঝা মুশকিল। ফারহানা ম্যাডাম অরুণিমার এই মনোযোগ ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছিলেন কিন্তু সহজভাবে নেননি। অরুণিমাকে সরাসরি অফিসের কোড অব কনডাক্ট মেনে চলার পরামর্শ দিলেন। না হলে তার বিপক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে তাও বললেন।
এদিকে বিষয়টা শামীমও মেনে নিতে পারেনি। মিটিঙের পরে সরাসরি মুরশীদের রুমে চলে গেলো সে। কোন রকম ভণিতা ছাড়াই বললো, ‘মুরশীদ ভাই, আমরা তো একটা টিম নাকি? অরু কেমন আপনি জানেন না? কিছু তো সাপোর্ট দিতে পারতেন আপনি!’
মুরশীদ নির্লিপ্ত মুখে বললেন, ‘তোমার বন্ধুর কিছু বলার থাকলে সে-ই বলুক, তোমার কথা তুমি বলো’।
‘সেটাই তো বলছি। এভাবে টিম ওয়ার্ক হয় না’।
‘দেন, গো এন্ড কমপ্লেইন। আমাকে টিম লিডার মানতে পারছো না সেটা জানাও অথরিটিকে’।
‘ইউ আর রিয়েলি ইমপসিবল, মুরশীদ ভাই!’ শামীম যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো। অরুণিমার কী অবস্থা কে জানে। যেভাবে কাঁদছিলো মেয়েটা।
অরুণিমাকে তাদের রুমেই পাওয়া গেলো। ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে কী কী ঢুকাচ্ছে। সে যে খুব অস্থির হয়ে আছে দেখেই বোঝা যায়। হাত কাঁপছে রীতিমত। ফোঁপাচ্ছে থেকে থেকে।শামীম তার পাশে এসে দাঁড়ালো, ‘কী করছিস তুই?’
‘বাসায় চলে যাচ্ছি আমি, ভালো লাগছে না’। মেয়েটা কথাই বলতে পারছে না, শ্বাস নিচ্ছে টেনে টেনে।
‘আমি পৌঁছে দিয়ে আসি তোকে, চল’।
দরজায় টোকা পড়লো সে সময়। ‘ভেতরে আসব?’ মুরশীদ স্যারের গলা।
অরুণিমা অবিশ্বাসী চোখে তাকালো সেদিকে। শামীমকে দেখে মুরশীদ স্যার বললেন, ‘উইল ইউ এক্সকিউজ আস, প্লিজ?’
শক্ত মুখে অরুণিমার দিকে একবার তাকিয়েই বেরিয়ে গেলো শামীম।
অরুণিমার ডেস্কের সামনের চেয়ারে হাত রেখে মুরশীদ স্যার বললেন, ‘বসতে পারি?’ অরুণিমা কিছুই বললো না। যা খুশি করুক ভদ্রলোক, কিচ্ছু যায় আসে না তার।
‘আপনি কী ফ্রি আছেন?’মুরশীদ কৌতূহল নিয়ে তাকালেন মেয়েটার দিকে। কে বলবে ইনি একজন এডাল্ট। সারা মুখ লাল করে রেখেছে। চোখ রক্তাভ। এতটা ভেঙ্গে পড়ার কী আছে, আশ্চর্য! এসব মেয়েরা চাকরি করে কীভাবে!
‘আমার সময় কম, চলে যাচ্ছি’। অরুণিমা কাটা কাটা উত্তর দেয়।
‘একেবারে চাকরি ছেড়ে দিয়েই যাচ্ছেন নাকি?’ কৌতুককন্ঠে জানতে চাইলেন মুরশীদ স্যার। আর তখনই অরুণিমার নাক থেকে সরু রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে দেখলেন তিনি।
‘আপনি ঠিক আছেন তো…’ বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আর অরুণিমা টলে পড়ে যাবার মুহূর্তে জড়িয়ে ধরে ফেললেন তাকে।
৮.
পলাশ যখন কেবিনে ঢুকলো, মুরশীদ সে সময়ে অরুণিমার হাত ধরে পাশেই বসেছিলেন। অফিস থেকে হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত ক্ষণিকের জন্যও হাত ছাড়েননি অরুণিমার। এমনকি অফিসে অরুণিমাকে যতক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন তখন তার চোখে পানিও দেখেছে শামীম। বিড় বিড় করে কী সব বলছিলেন। এসব কথা পরে শামীমের কাছ থেকেই শুনেছে অরুণিমা।
পলাশ ঢাকায় ছিলো না। খবর পেয়েই রওনা দিলেও পৌঁছাতে দেরি হলো অনেক। অরুণিমা তখন ঘুমে। মুরশীদকে তার স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলো সে। বিব্রতও। তাকে দেখেও হাত ছেড়ে দেননি তিনি। কিংবা তাকে দেখেনও নি ঠিকমতো। ভদ্রলোকের চোখে অদ্ভুত উদাসীনতা দেখেছে সে, তার দিকে তাকিয়েও যেন তাকে দেখেননি।
‘মুরশীদ ভাই, আপনার এখন বাসায় যাওয়া উচিত, অনেক ছুটোছুটি করলেন’। পিঠের উপর হাত রেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললো শামীম। ‘অরুর হাসব্যান্ড চলে এসেছে’।
শামীমের কথায় উঠে দাঁড়ালেন মুরশীদ। অরুণিমার হাত তখনো তার মুঠিতে ধরা। পলাশের সাথে হাত মেলাতে গিয়ে সে কথা খেয়াল হলো তার। আলতোভাবে অরুণিমার হাত নামিয়ে রেখে ক্লান্ত স্বরে পলাশকে বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই, রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’।
শামীমও তার সাথে নেমে এলো। ‘আপনি কী ড্রাইভ করতে পারবেন মুরশীদ ভাই? আপনাকে তেমন স্টেবল মনে হচ্ছে না। তাছাড়া রক্তও তো দিলেন কতোগুলো’।
শামীমের ঘাড়ে হাত রেখে আস্বস্ত করলেন মুরশীদ। মুখে কিছু বললেন না। মুরশীদ নিজেও জানেন তিনি স্টেবল নন। কিন্তু এ মুহূর্তে কারো সাথেই থাকতে মন চাচ্ছে না। অরুণিমার পাণ্ডুর মুখটা মন থেকে কিছুতেই মুছে যাচ্ছে না তাঁর। বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেক আগের কষ্টের স্মৃতি। বীথির কেমোথেরাপী দেবার দিনগুলো। কেমোর পরের কয়েকটা দিন খুব কষ্টে যেতো। নাক দিয়ে ব্লিডিং হতো অনেক, হঠাৎ হঠাৎ অচেতন হয়ে যেতো বীথি। সেসব দৃশ্যের পূনরাবৃত্তি মুরশীদ আর দেখতে চায় না, কারোর জন্যই না।
বাসায় পৌঁছালো যখন, তখন অনেক রাত। বীথিকে তো তেমন কিছু জানানোও হয়নি। শুধু বলেছিলো সে হাসপাতালে। ফিরতে দেরি হবে। বীথিও আর কিছু জানতে চায় নি। বাসাটা অন্ধকার হয়ে আছে। রান্নাঘরের লাইট জ্বলছে শুধু। সবাই ঘুমিয়ে গেছে মনে হয়। তার ঢোকার শব্দে বীথি উঠে এলো। মুরশিদের বুকের কাছে লেগে থাকা রক্তের দাগে এক নজর তাকালো। প্রশ্ন করলো, ‘খাবে না কিছু? খিদে পেয়েছে তো? মুখ হাত ধুয়ে খেয়ে নাও’।
টাই খুলতে খুলতে সোফার উপর বসলো মুরশীদ। বসে থেকেই বীথিকে নিজের দিকে আকর্ষণ করলো। বীথির বুকে মুখ রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কতোদিন পর? আসলেই মনে নেই তার, কতোদিন পর এভাবে জড়িয়ে ধরা। বীথি মাথায় হাত রাখলো মুরশীদের। সে বুঝতে পারছে মানুষটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
অনেকদিন পরে সেই রাতটা অন্যরকম ভালোবাসায় কাটলো তাদের।
৯.
ছুটির সকালগুলোতে ঘুম আগে ভাগেই ভেঙ্গে যায় মুরশীদের। সকালটা মন দিয়ে উপভোগ করে। আজ অবশ্য নিজে থেকে ঘুম ভাঙেনি, ফোনের শব্দে জেগে গেছে। কয়েকটা মিসড কল উঠে আছে। বেশ বেলা হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। বীথি পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে দিয়ে গেছে। মোবাইলটা সরাতে মনে নেই বোধহয়। ঘুম ভেঙেই প্রথমে লক্ষ্য করেনি, ফারহানা হকের কল। ছুটির দিনে অফিসের মানুষ কল করলে ভালো লাগেনা। তার উপর কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। সারাদিন ধকলও গেছে অনেক। এ মুহূর্তে নতুন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি অরুণিমার খবর নেওয়ার কথাও খেয়াল হয়নি তার। এমন সময়ে ফোনটা আবার বেজে উঠলো।
রিসিভ করে উঠে বসলেন বিছানায়।
‘ঘুম ভাঙলো তাহলে?’ গলায় শ্লেষ মিশিয়ে প্রশ্ন করলেন ফারহানা হক। ‘সারারাত কি অরুণিমার কাছেই ছিলে?’
‘যা বলতে চাও সোজাসুজি বলো’, শান্ত গলায় উত্তর দিলো মুরশীদ।
‘সরাসরিই বলছি, কাল যা দেখলাম! তোমার এত বেশি অধঃপতন আমি দেখবো চিন্তাও করিনি’।
‘কী অধঃপতন দেখেছো?’
‘তুমি বোধহয় নিজেও জানো না মেয়েটাকে কীভাবে আর কতক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলে। ছিঃ ছিঃ’।
‘আর, তুমি বোধহয় জানো না মেয়েটা সে সময়ে অচেতন ছিলো, আমি না ধরলে পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পেতে পারতো’।
‘সেটাই তো প্রশ্ন! কী এমন করেছিলে তুমি যে সে অজ্ঞান হয়ে গেলো? আমাকে কী মনে হয় তোমার? তোমার বউয়ের মতো আমিও ঘাস খেয়ে থাকি?’
মনটা তিক্ততায় ভরে গেলো মুরশীদের। ঘটনার এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে তার মাথায় আসেনি। বুঝতে পারলো সামনে আরো লড়াই আছে। বিশেষ করে তাদের যে প্রজেক্ট নিয়ে এত ঘটনা সেটাতে ডিরেক্টর থাকবে অরুণিমা, ইমপ্লিমেন্টিং অর্গানাইজেশন সেটাই চায়, এ কথা জানলে ফারহানার অভিব্যক্তি কী হবে ধারণা করতে পারে মুরশীদ। অরুণিমার সুখবরটা জানা ছিলো বলেই মিটিঙে বাড়তি কিছু বলেনি সে। অরুণিমাদের রুমে এ খবরটা দিতে নিজেই গিয়েছিলো।
মুরশীদকে নিশ্চুপ দেখে আরো রেগে গেলো ফারহানা। ‘তোমার দিকে মেয়েটা সারাক্ষণ কীভাবে চেয়ে থাকে দেখিনি আমি ভেবেছো? কি নতুন খেলা শুরু করেছো তুমি, অ্যাঁ?’
‘ফারহানা, তুমি খুব ভালো করেই জানো নতুন পুরোনো কোনো খেলাই খেলছি না আমি। এনিওয়ে, আমি এখনো বিছানা ছাড়িনি। তোমার এসব অভিযোগ পরে শুনি, ঠিক আছে?’ অপর পক্ষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে দিলো ফোনটা।
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইলো সে কিছুক্ষণ। ‘আসবো বাবা?’ মেয়ের গলা পাওয়া গেলো বাইরে। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। হাসিমুখে মেয়েকে ডাকলেন কাছে। ‘তোমার শরীর ভালো আছে বাবা? কাল নাকি অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার?’
‘তেমন কিছু না মা, একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো, এখন সব ঠিক’।
‘হ্যাঁ বাবা, মা বললো তোমার শার্টে নাকি রক্ত লেগে ছিলো?’
‘মা, আমি ফ্রেস হয়ে আসি, খিদে পেয়েছে অনেক’। মেয়ের জেরা থেকে বাঁচতে বাথরুমের দিকে রওনা হলো মুরশীদ।
১০.
এক রাত এক দিনের দীর্ঘ হাসপাতাল বাস ছেড়ে পলাশ অরুণিমাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অরুণিমা অনেকটাই সুস্থ্। ডাক্তার নার্ভাস ব্রেকডাউনের কথা বলেছেন। দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তায় এমন হতে পারে। এত কী নিয়ে দুশ্চিন্তা পলাশ ধারণা করতে পারে না। আগে শুনেছিলো ওদের অফিসে নাকি অনেক ধরনের রাজনীতি চলে। নতুন করে কিছু ঘটেছে হয়তো। আর এই মুরশীদ ভদ্রলোককে জড়িয়েও কিছু হতে পারে। কারণ ঘুম ভেঙ্গে অরুণিমার প্রথম কথাই ছিলো, মুরশীদ স্যার কোথায়? উনি কি এসেছিলেন? সদুত্তর না পেয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো, ফোন করেছিলেন স্যার? আমি কেমন আছি জানতে?
ব্যস, কথা শেষ। নিজের ছেলের কথাও জিজ্ঞাসা করেনি। পলাশ এ নিয়ে অবশ্য উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ সে অরুণিমাকে ভয় পায়, তার খেয়ালকে ভয় পায়। পলাশের ধারণা তার কোন কথাই অরুণিমার কাছে গুরুত্ব পায় না। এই একগুঁয়ে, খেয়ালি মেয়েটার সাথে সে কেন জড়িয়ে আছে এতদিন সেও এক বিস্ময়। শুধু সে না, এই মেয়েকে ভালোবাসার লোকের সংখ্যা কম না।
যেমন তাদের বুয়া। বুয়া প্রায় প্রতিদিন ‘আপনার সাথে আমার পোষাবে না’ বলে বিদায় নেয়। পরদিন গজ গজ করতে করতে কাজে যোগ দেয়। অথচ অরুণিমা কখনোই তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলে না। আজ বাসায় ফেরার পর সবচেয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বুয়া। অরুণিমা রোগা হবার চেষ্টায় একবেলা করে খায় এটি তার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ। এত বড় মানুষের খাওয়া যদি এমন হয় তাহলে চলে কেমন করে! বুয়া অবশ্য পলাশকেও দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। বউকে যে শাসন করেনা সে কেমন পুরুষ মানুষ তা নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান।
অরুণিমাকে যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পলাশ, সে মুহূর্তে হেসে ওঠে সে। ‘তুই কি রুগী পেয়েছিস আমাকে?’
ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে পলাশ বলে, ‘হাসপাতাল থেকে আসলে তো তাই ভাবা উচিত’।
‘উফফ! যা তো বুয়াকে বল দুকাপ চা দিয়ে যেতে। অনেকদিন পর ছুটি পাওয়া গেলো। তোকেও পাওয়া গেলো। একসাথে বসে চা খাই’।
পলাশ চা-এর কথা বলতে দরজা পর্যন্ত যেতেই অরুণিমা পেছন থেকে ডাক দেয়, ‘মোবাইলটা দিয়ে যাস তো।‘
পলাশ নিজেই চা নিয়ে ফিরে আসে। কিন্তু অরুণিমা রুমে নেই। সে বারান্দায় পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। মোবাইলটা কোলের ওপর রাখা। গান বাজছে, ‘কিচ্ছু চাইনি আমি, আজীবন ভালোবাসা ছাড়া, আমিও তাদেরই দলে বার বার মরে যায় যারা…’। অরুণিমার দৃষ্টি স্থির, ক্যানোলা লাগানো হাত অবিন্যস্ত পড়ে আছে কোলের ওপর। তার মুখ দেখে পলাশের বুকটা হাহাকার করে উঠলো। অরুণিমা কখনো কিছু চায়নি তার কাছে। ভালোবাসা বুঝি মুখ ফুটে চাওয়া যায়!
পলাশ হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসে চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখে। অরুণিমা একবার দেখে তাকে শুধু। ‘চা খেতে আর ইচ্ছে করছে না রে’, করুণ মুখে বলে ওঠে ।
দুহাত দিয়ে অরুণিমার মুখটা তুলে ধরে পলাশ, ‘কী কষ্ট তোর বুড়ি? আমাকে বলা যায় না?’
ম্লান হেসে পলাশকে প্রবোধ দেয় অরুণিমা, ‘কষ্ট নেই তো, আমি ভালো আছি’।
অরুণিমার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে পলাশ বলে ওঠে, ‘খাওয়া দাওয়া ছেড়েছিস কেন?’
‘মোটা হয়ে যাচ্ছি’, অকপট স্বীকারোক্তি অরুণিমার। ‘আচ্ছা শোন, আমি কেন অনেক সুন্দর হলাম না বল তো?’
এমন আক্ষেপ এর আগে সে শোনেনি স্ত্রীর মুখে। ‘হা হা, তুই খারাপ কিসে বলতো?’
‘না, ধর দীঘল কালো চুল হতো যদি, আমার তো চুলই নাই মাথায়। আর গমের শীষের মতো গায়ের রঙ। সিনেমার নায়িকাদের মতো। তারপর ধর, বড় টানা টানা চোখ’।
‘হুম, বুঝলাম। তাহলে তো এই এলোমেলো ছোট চুলে ঘেরা দুষ্টু মিষ্টি মুখটা আমার অদেখাই থেকে যেতো। আর এই স্বপ্নমাখা চোখজোড়া আমি কোথায় পেতাম? তোর এই চোখের যে কী মায়া রে বুড়ি’, পলাশ একটা চুমু খায় স্ত্রীর কপালে।
‘তাই? তাই কি মুরশীদ স্যার আমার চোখে সহজে তাকায় না?’
পলাশের হাত স্থির হয়ে গেলো অরুণিমার কপালে। ‘এই মুরশীদ স্যার কে রে?’
‘আমার ক্রাশ’, মুচকি হাসে অরুণিমা।
১১.
একটা সপ্তাহ বিরতি দিয়ে অফিসে এসেছে অরুণিমা। নিজের ডেস্কে বসে কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে তার।গত সাত দিনে একবারও ফোন করেননি মুরশীদ স্যার। শামীমের কাছ থেকে গত কদিনে অসংখ্যবার সে সেদিনের ঘটনা শুনেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে মুরশীদ স্যার সেদিন কী কী করেছিলেন। শামীম বোকা নয়। সে বুঝতে পারছে অরুণিমার ভেতরে কিছু একটা ঘটছে।
অরুণিমার লাজুক মুখে বসে থাকা দেখে সে কিছু আন্দাজ করলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এবার মন দিয়ে কাজ শুরু কর। তোর তো নতুন দায়িত্ব পড়েছে’।
‘কী নতুন দায়িত্ব?’
‘ওমা! তুই জানিস না এখনো? মুরশীদ ভাই কিছু বলেনি তোকে?’
‘নাহ, উনি কিছু বলেননি। অরুণিমার মুখে রক্তাভা দেখলো শামীম’।
‘ওহ, তাহলে বলবেন হয়তো’।
‘আমি কী যাবো উনার রুমে? ইতস্তত করে জানতে চাইলো অরুণিমা’।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো শামীম, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করিস কেন? ইচ্ছা হলে যা’।
একরাশ অস্বস্তি নিয়ে অরুণিমা দাঁড়িয়ে আছে মুরশীদ স্যারের দরজার সামনে। সাতদিন পর দেখবে তাঁকে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা লাগছে তার। দরজায় নক করে উঁকি দিলো অরুণিমা, আসবো স্যার?
মুরশীদ স্যার একা ছিলেন না। ফারহানা ম্যাডামও আছেন ভেতরে। অরুণিমা গুটিয়ে গেলো একটু। স্যার চেয়ারে বসা আর ফারহানা ম্যাডাম তার দিকে মুখ করে টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। মজার কিছু নিয়ে কথা হচ্ছিল মনে হয়। দুজনার মুখ হাসি হাসি।
ভেতরে ঢুকে কী বলবে স্থির করতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো অরুণিমা। অরুণিমার গলার স্বরে তার দিকে তাকালেন মুরশীদ স্যার। হেসে বললেন, ‘আসেন আপা’। নিজে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে বললেন মুরশীদ স্যার। ফারহানাও ঘুরে তাকালেন। আন্তরিক ভঙ্গিতে জানতে চাই্লেন অরুণিমা কেমন আছে।
অরুণিমা বসার পর ফারহানা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তারপর অরুণিমা, মুরশীদকে তুমি কী জাদু করেছো বলতো? কিছু টিপস আমাকেও দিও।
অরুণিমা একটু অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে মুরশীদ স্যারের দিকে তাকালো। কোন উত্তর দিলো না।ফারহানা এবার মুরশীদের দিকে একটু হেসে বের হয়ে গেলেন। মুরশীদ স্যার মনে হলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। এ ধরনের আলোচনায় বরাবর অপটু তিনি।
অরুণিমার কেন যেন সব নতুন লাগছে আজ। এই রুমে বসে কতদিন প্রজেক্টের কাজ করেছে সে। অনেক আড্ডাও হয়েছে। প্রায় দিনই স্যার তাদের নিজের বানানো কফি খাওয়াতেন। সেই কফি বানানোর আয়োজন ছিলো ব্যপক। কফি আর অল্প পানি দিয়ে ফেনা করা হতো। তাতে গরম দুধ মেশানো হতো। অরুণিমা সে সময়ে একদৃষ্টিতে খেয়াল করতো মুরশীদ স্যারকে। স্যার ফুল শার্টের হাত গুটিয়ে রাখতেন। টাই থাকতো পকেটে। মিটিং থাকলে তখন পকেট থেকে টাই বের করে কোট পরে রেডি হয়ে যেতেন। তার টাই প্রায় সময় বেঁধে দিতো শামীম নাহয় আশরাফ। একদিন ফারহানা ম্যাডামকেও টাই ঠিক করতে দেখেছে সে।
গানও হতো মাঝে মাঝে। শামীম একদিন গিটার দেখে ফেলেছিলো স্যারের রুমে। তারপর থেকে প্রায়ই তাদের আবদার থাকতো মুরশীদ স্যারের কাছে গিটার বাজিয়ে গান শোনানোর। গান অবশ্য উনি শোনাননি কখনো, গিটারে সুর তুলে শুনিয়েছেন।
‘আপনি এখন সুস্থ পরোপুরি? যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে!’ মুরশীদ স্যারের গলায় ঘোর কাটলো অরুণিমার। উত্তরে হাসলো শুধু সে।
মুরশীদ ভালো করে লক্ষ করলো অরুণিমাকে। একটু যেন শুকিয়েছে। মুখটা মলিন লাগছে। চুলও কেটেছে মনে হয়, ছোট চুলে চেহারাটা অড্রে হেপবার্নের মতো দেখাচ্ছে। মুরশীদের ইচ্ছে হলো অরুণিমাকে জিজ্ঞাসা করবে কেন সে সময় চেয়েছিলো তার কাছে। কিন্তু অরুণিমা হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো। ‘আমি যাই স্যার’।
মুরশীদ একটু অবাক হলেও তাড়াতাড়ি উঠে অরুণিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ‘আপনার শরীর খারাপ লাগছে না তো?’ দেখলো অরুণিমার চোখে জল জমতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে অরুণিমা বলে উঠলো, একটু খারাপ লাগছে, আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব। মুরশীদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বের হয়ে গেলো সে।
১২.
অনেকখানি কান্না আর অভিমান দলা পাকিয়ে বুকের কাছে জমে আছে অরুণিমার। কেন যে মুরশীদ স্যারকে দেখলে তার এমন লাগে! অথচ সে অনেক ভেবে দেখেছে, পলাশের জায়গায় কখনোই মুরশীদ স্যারকে বসাতে পারবে না সে। তাহলে এই অনুভূতির উৎস কী? সে কি কিশোরী একটা মেয়ে? অজানা অভিমানে অরুণিমা লাঞ্চে গেলো না, নিজের ডেস্কে একমনে কাজ করতে থাকলো।
অরুণিমার আচরণে মাঝে মাঝে অবাক হয় মুরশীদ। মেয়েটা বোকা নাকি অতিমাত্রায় সরল! গত ক’দিনে অফিসে তার কত কি যে ম্যানেজ করতে হয়েছে অরুণিমা কল্পনাও করতে পারবে না। ফারহানা ধরেই নিয়েছে অরুণিমার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক! এ ধরনের আচরণ সে অফিসে প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু ফারহানা নিজেই মাঝে মধ্যে এমন কিছু আচরণ করে যাতে মনে হতে পারে সে-ই মুরশীদের সাথে ঘনিষ্টতা করতে চায়। বিষয়গুলো এড়িয়েই এসেছে এতদিন সে। মূল কথা হলো, অরুণিমার নতুন অফার তাকে অনেক বড় পজিশনে নিয়ে যাবে। এটা মেনে নেয়া ফারহানার পক্ষে যথেষ্ট কঠিন।
তার মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও চলে যেতে। এত ডিপ্লোম্যাসি কার ভালো লাগে! তার চেয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করলে এতদিনে প্রফেসর হয়ে যেতেন। তবে প্রফেসরের জীবনও এসব স্ক্যান্ডালের উর্ধ্বে নয়।আদনানের কথা মনে পড়ে । কী সম্পর্ক ছিলো অরুণিমার সাথে? কৌতূহল হয় মাঝে মাঝে তার।
মুরশীদ ঠিক করলো নিজে অরুণিমার রুমে গিয়েই নতুন প্রজেক্টের কাজগুলো ব্রিফ করে আসবে। কন্ট্রাক্টও তো করতে হবে একটা। কাজ অনেক। আবার অরুণিমার আর্দ্র চোখ দুটোর কথাও মনে পড়ছে বার বার। এত বাঙময় চোখ কখনো কি দেখেছে সে!
লাঞ্চ সেরে তাদের রুমের দিকে যেতে বাইরে শামীমের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তার দিকে তাকিয়ে হেসে মুখ ফুলিয়ে রেগে থাকার ভঙ্গি করে দরজার দিকে ইশারা করলো। শামীমের মুখ ভঙ্গিতে হাসি পেয়ে গেলো মুরশীদের। মোটামুটি আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে রুমের দিকে এগোলো সে।
কী ভেবে নক না করেই ভেতরে ঢুকে গেলো মুরশীদ। অরুণিমা চেয়ারে বসে দূরের আকাশে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে তার সুদূরের গভীরতা। মুরশীদের উপস্থিতি টের পেলো না মোটেই।
মুরশীদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সে মৌনতা ভাঙ্গতে পারলো না।
১৩.
চিন্তিত দৃষ্টিতে নিজের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে মুরশীদ। টেবিলে ছাইরঙা পাঞ্জাবি রাখা। এটা পরে তাকে অফিস থেকে বের হতে হবে। অফিসে পাঞ্জাবি পরা তার খুবই অপছন্দ। কিন্তু আজ বিশেষ একটা দিন। তার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে একটা গেট টুগেদার। যদিও সেকেন্ড ইয়ারের পর সে দেশের বাইরে চলে যায়। কিন্তু বন্ধুরা খুঁজে বের করেছে তাকে। অনেকদিন ধরেই প্ল্যান হচ্ছিলো। আজ সেই দিন। পাগলা শাহরিয়ার সবার জন্য একই পাঞ্জাবি বানিয়েছে। ব্যানার করা হয়েছে। হুলুস্থুল ব্যাপার।
রেস্টরুমের আয়নায় পাঞ্জাবি পরা নিজেকে দেখছে মুরশীদ। কত বছর পেরিয়ে গেছে জীবনের! নিজেকে পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে সে। বয়স আর পজিশন চেহারায় ভারিক্কি একটা ছাপ এনে দিলেও চশমার আড়ালে কোথায় যেন বয়সটা থমকে গেছে তার! মুরশীদের জীবনে সবকিছুই সময়ের আগেই পাওয়া। বিয়ে, বিদেশের ডিগ্রী, মেয়ের জন্ম, স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ক্যান্সারের সাথে লড়াই, আরো সব পারিবারিক দায়িত্ব, সব কিছুর মাঝে নিজের জন্য আলাদা করে সময়ই পায়নি সে। গড়ে ওঠেনি সব শেয়ার করার মতো কোন বন্ধু। মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে বসে, সুরগুলোকেই আপন সখার মতো মনে হয়।
আজ যাদের সাথে দেখা হবে, দেশ ছাড়ার পর কারো কারো সাথে যোগাযোগ ছিলো। পরে আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেছে। ফেসবুকের কল্যানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো নিজেদের খুঁজে নিয়েছে। মুরশীদ কিছুটা স্বভাববিরুদ্ধ উত্তেজনা বোধ করছে, কেমন হবে এই মিলন মেলা?
সন্ধ্যা পার করে অফিস থেকে বের হলো সে। পুরো অফিস নিরব। অজান্তেই অরুণিমাদের রুমের দিকে চোখ গেলো তার। অন্ধকার সেখানেও। আপনমনেই হাসলো সে।
আয়োজন একটা ক্যাফেতে। ছাদের উপরে। বেশ বড় পরিসরে বসার ব্যবস্থা।মুরশীদের মনে হলো অরুণিমার বেশ পছন্দ হবে জায়গাটা। ভাবনাটা আসতেই লজ্জা পেলো সে। তখনই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শাহরিয়ার, ‘কতদিন পর দেখা দোস্ত’। সেই আন্তরিকতা তাকে স্পর্শ করলেও অতটা সহজ হতে পারলো না মুরশীদ। একে একে দীপ্ত, সুমন, কবির, মাইকেল আরো অনেকের সাথে দেখা, সবাইকে যে চিনতে পারলো তা নয়। তবে স্মৃতির ঝাঁপি খোলার পর কিছু কিছু ঘটনা তারও মনে পড়তে থাকলো।
স্মৃতিচারণ, ফটোসেশন, খাওয়া দাওয়া সব শেষ। ছোট ছোট দলে যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। মুরশীদ একটা টেবিলে বসেছিলো। দুহাতে দু গ্লাস হুইস্কি নিয়ে শাহরিয়ার মুখোমুখি বসলো এসে।
‘তারপর? তোর জীবন কেমন চলছে বল? ভাবী বাচ্চা সবাই কেমন আছে?’ শাহরিয়ার জানতে চায়।
‘হ্যাঁ, সব চলছে ভালো। তোর কী খবর?’ মুরশীদ আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। ‘আচ্ছা, অনেকেই তো আসেনি দেখছি?’
‘হুমম, দেশের বাইরে আছে কিছু। শাহানাকে মনে আছে? সে তো ইউকে-তে থাকে, দেখলে চিনতে পারবি না। শাড়ি টাড়ি ছেড়ে এখন শর্টস্কার্ট পরে থাকে। আরে, মনে নাই, সেই যে মাথায় ঘোমটা ছাড়া ক্লাসেই আসতো না? আর ছেলেরা কথা বলতে চাইলেই মাথা নিচু করে ফেলতো?’
হাসলো মুরশীদ, কিছুটা মনে পড়ছে বটে। পুষ্প স্যারের কথাও মনে পড়ে গেলো। হেসে বললো সে, ‘পুষ্প নামের একজনের সাথে স্ক্যান্ডাল ছিলো না স্যারের?’
‘হা হা, যে সে স্ক্যান্ডাল না রে, রীতিমত টুএক্স’, গ্লাসে চুমুক দিলো শাহরিয়ার।
‘আচ্ছা আদনানের কী খবর রে? ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছিলো না? ওর সাথে আমার কিন্তু দেখা হয়েছিলো একবার, এয়ারপোর্টে। কথা বিশেষ হয়নি অবশ্য’।
‘হ্যাঁ তুই চলে যাবার পর তো ফার্স্ট পজিশন ওর দখলে চলে যায়। কিন্তু টিকতে পারে নি রে। ওর ও সেইম কেস’।
‘তাই নাকি?’ মুরশীদ একটু আগ্রহী হয়। ‘কী হয়েছিলো বলতো?’
আর বলিস না। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে, আদনানের সাথে একটা প্রজেক্টে কাজ করতো। তাকে জড়িয়েই তো কাহিনী। তদন্ত কমিটি হলো, আদনানের চাকরি গেলো, পরে তো আয়ারল্যান্ড চলে গেলো সে। অরুণিমা নাম ছিলো মনে হয় মেয়েটার।
নামটা কানে যেতেই চমকে তাকায় মুরশীদ।
১৪.
‘অরুণিমা!’ নিজের মনেই একবার উচ্চারণ করে মুরশীদ।
‘চিনিস নাকি?’ শাহরিয়ার আগ্রহী হয় একটু।
‘একজনকে চিনি। আমার সাথেই কাজ করে। কিন্তু এই অরুণিমা সে-ই কিনা তা জানি না। আচ্ছা কী ঘটেছিলো বলতো’।
‘যা ঘটে আর কি। আদনান জন্স হপকিন্সের একটা প্রজেক্ট পেয়েছিলো। ভালো ফান্ড। এই সুবাদে আসিফ স্যারের সাথে পরিচয় হয় তার। স্যারের মেয়ে ডোনার সাথে বিয়েও হয়। ডোনা অনেক বেশী পজেসিভ ছিলো। ক্যাম্পাসে আদনানের নিজস্বতা বলতে কিছুই ছিলো না। ডোনার আড়ালেই থাকতো’।
‘তারপর?’
‘সেই সময় ডোনা পিএইচডি করতে আয়ারল্যান্ড চলে যায়। আদনানকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কোনো কারণে তখনই যেতে পারেনি সে। ডোনা যাবার পর আদনান স্বরূপে ফিরে আসে’।
‘স্বরূপ মানে?’
‘তুই তো অত কিছু জানতি না। আদনান বরাবর মেয়েদের পিছে ছোঁক ছোঁক করতো।‘
এই কথায় মুরশীদ হেসে ফেললো। বললো, ‘আচ্ছা তারপর?’
‘আদনানের প্রজেক্টে অরুণিমা কাজ করতো। আদনান তার স্টুডেন্টদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফিল্ডে যেতো। অরুণিমাও তাদের একজন ছিলো। তখন থেকেই হয়ত কোনরকম সম্পর্ক তৈরি হয় তাদের মধ্যে। কানাঘু্যা ছিলো অনেক। অরুণিমা সেসব পাত্তা দিতো না। ডোনার কানেও যায় সবকথা। একদিন ডোনা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে আসে। সরাসরি ডিপার্টমেন্টে উপস্থিত হয়’।
‘কিছু দেখেছিলো ডোনা?’
‘আর বলিস না। আদনানের ভাগ্য এতই খারাপ! সেই সন্ধ্যায় অরুণিমাকে চেম্বারে ডেকেছিলো। আদনান আর অরুণিমার মাঝে অনেক বাক বিতন্ডা হয়েছিলো। ডোনা বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলো’।
‘কি রকম বাক বিতন্ডা? অন্য কিছু হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিলো’।
‘হা হা’, শাহরিয়ার চোখে ইঙ্গিত করলো, ‘না রে বন্ধু। মেয়েটা মনে হয় সেরকম ছিলো না। ডোনা তো আদনানকে মোটামুটি আহত অবস্থায় উদ্ধার করে’।
‘কি বলিস?’
‘হ্যাঁ, পরে শুনেছিলাম, আদনান নাকি অরুণিমাকে ডিপার্টমেন্টে নিতে চেয়েছিলো, বিনিময়ে তাকে কু-প্রস্তাব দিয়েছিলো। আর অরুণিমা আদনানকে বলেছিলো, যোগ্যতা থাকলে সে নিজেই তার জায়গা করে নেবে, আদনানের ফেভার তার লাগবে না। এসব কথা শুনে আদনানের মাথা গরম হয়ে যায়। অরুণিমাকে অনেক বাজে কথা বলেছিলো। অরুণিমার দাম নাকি ৫০০ টাকাও হবে না এমন কথাও বলেছিলো। অনেক ধ্বস্তাধস্তি হয়েছিলো তাদের মধ্যে। আদনান জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিলো। অরুণিমা সুযোগ বুঝে আদনানের নাক বরাবর একটা পাঞ্চ বসিয়ে বেরিয়ে আসে। ডোনা ঐ অবস্থায় উদ্ধার করে আদনানকে। অবশ্য আঘাত অরুণিমাও পেয়েছিলো অনেক। হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো’।
‘পরে কী হলো?’
‘পরের ঘটনাও মজার। তদন্ত কমিটি হলো, আসিফ স্যার কিভাবে যেন আদনানকে সব কিছু থেকে বাঁচিয়ে ডোনার সাথে আয়ারল্যান্ড পাঠিয়ে দিলেন’।
‘আর অরুণিমা?’
‘অরুণিমা কেন জানিনা পরের দিনই তার এক বন্ধুকে বিয়ে করে ফেললো। পলাশ নাম ছেলেটার, পায়ে একটু সমস্যা আছে যদিও। কিন্তু খুব ভালো ছেলে। আমার সাথে ভালো পরিচয় আছে’।
১৫.
‘চলো একবার সমুদ্র দেখে আসি। যাবে?’বীথির ছড়িয়ে থাকা চুল কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বলে মুরশীদ।
‘শেষবার?’ স্বভাবসুলভ হাসিমুখে প্রশ্ন করে বীথি। একটু চমকালেও মুরশীদ কিছু বললো না, আরও কাছে টেনে নিলো স্ত্রীকে। তার খুব অস্থির লাগছে, দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে তার খুব একা লাগছে নিজেকে। কী যেন একটা ছেড়ে যাচ্ছে!
মুরশীদ অফিসে যায়নি আজ। সকাল থেকে তার মাথা ভার হয়ে আছে, জ্বরও এসেছে। বীথি ডাকতে এসেছিলো। শরীর খারাপ লাগছে বলাতে কপালে হাত দিয়ে দেখেছে। সে হাত মুরশীদ সরাতে দেয়নি। দুহাতে বীথিকে আলিঙ্গনে বেঁধেছে।
‘শোন, উঠে চা আর একটা প্যারাসিটামল খাও। ভালো লাগবে’।
উত্তরে বীথির গলায় একটা চুমু খেলো মুরশীদ। চোখ বন্ধ করে বলল, ‘তোমার আজকের দিনটা দেবে আমায়?’
মুরশীদের গলার আর্দ্রতা বীথিকে স্পর্শ করে। দুহাতে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মানুষটার।
মুরশীদ মনে হয় ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আবার। ফোনের শব্দে চোখ মেললো। মাথার ভেতর ফাঁকা লাগছে। জ্বর বেড়েছে মনে হচ্ছে। মোবাইলটা চোখের সামনে এনেও দেখতে কষ্ট হচ্ছে তার। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লাগে, অরুণিমা ফোন করেছে।
ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশের শীতল কন্ঠ শোনা যায়, ‘আপনি কী আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নাকি? অফিসে আসেন নি যে? কী ভেবেছেন, অফিসে আসলেই আসল ঘটনা জেনে যাবো আমি?’
‘অরুণিমা, কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলেন’।
‘হাহ, জলের মতো পরিষ্কার। স্যার, আমি শুধু দুদণ্ড সময়ই চেয়েছিলাম আপনার কাছে, আর কিছু না। আপনি কী ভেবেছেন আমাকে? একটা মানুষের আরেকটা মানুষকে ভালো লাগতে পারে না? আর ভালো লাগলে তা জানাতে দোষ কোথায়? আমি কি কোনভাবে আপনার কোন ক্ষতি করেছি?’
‘আপনি একটু শান্ত হবেন দয়া করে?’
‘স্যার, আমি শান্তই আছি। অশান্ত হবার মতো নতুন কিছু ঘটেনি আমার জীবনে’।
‘আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু কী প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে আমাকে বুঝিয়ে বলবেন একটু?’ একহাতে কপাল চেপে ধরে প্রশ্ন করে মুরশীদ।
‘উফফ, পারেনও আপনি। আমাকে অফিসের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তো, নাকি?’
‘অরুণিমা এটা আপনার অ্যাচিভমেন্ট। আপনি প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে যাচ্ছেন। নতুন ওয়ার্ক স্টেশনে আপনাকে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন বসতে হবে হার্ডলি। অফিসের বাইরে পাঠানোর কথা কেন আসছে?’
‘আপনি ফারহানা ম্যাডামকে বলেননি আমি যেন আপনাকে বিরক্ত করতে না পারি সেজন্য আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন, বলেন নি আপনি?’
‘আপনি এতো কেন অবুঝ অরুণিমা! অফিসে কী চলে চোখে পড়ে না আপনার! মুরশীদের গলার স্বর কঠিন হয়। এই অফিসে থেকে ফারহানার মনোভাব এতদিনে তো বোঝা উচিত ছিলো।
‘মনোভাব কী বুঝবো?’
‘প্রফেশনাল ঈর্ষা বোঝেন? আপনার অ্যাচিভমেন্ট সে মেনে নিতে পারে নি, তাই কায়দা করে ম্যানেজ করেছি তাকে। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল’।
অরুণিমা চুপ করে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ।
‘বোঝা গেছে নাকি আরো বোঝা লাগবে?’ ন্যূনতম কোমল না হয়ে প্রশ্ন করে মুরশীদ।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নেয় অরুণিমা, ‘আপনাকে না দেখে থাকতে আমার অনেক কষ্ট হবে’। আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেটে যায় ফোন।
১৬.
মাঝে মাঝে ফেরার পথে রিকশা নেয় অরুণিমা। আকাশ দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরে। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখে। কতজনের কত গল্প। কিন্তু কারো গল্প সে কল্পনা করে নিতে পারে না। কল্পনার জোর থাকলে বড় লেখক হতে পারতো। এই ব্যর্থতা মাঝে মাঝে দুঃখ দেয় তাকে।
রিকশায় বসে থাকা একটা লোককে দেখে হঠাৎ করেই মুরশীদ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন ফোন রাখার পর খুব কষ্ট হয়েছে তার। স্যার অসুস্থ ছিলেন, গলা শুনেই বুঝেছিলো সে। তারপরও কতগুলো কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সেদিনের পর দুসপ্তাহের বেশি কেটে গেছে। অরুণিমা নতুন কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছে, অফিসের দিকে যায়নি। কেউ তাকে ফোনও করেনি।
আকশে আজ মেঘ করেছে। কালো মেঘের দল ধীরে ধীরে গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলছে। জ্যামের মাঝে অনেকক্ষণ সেটাই দেখছে অরুণিমা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরতে শুরু করেছে। অরুণিমার চোখের উপর একটা বড় ফোঁটা এসে পড়লো, চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।
চোখ বন্ধ করেই টের পেলো আশেপাশে দারুণ হৈ চৈ শুরু হয়েছে। ততক্ষণে বৃষ্টির জোরও বেড়েছে।অরুণিমা চোখ মেলে বুঝতে চেষ্টা করে কী ঘটছে চারপাশে। রিকশাওয়ালা আপা আপা করে ডাকছে, ডানপাশে একটা গাড়ি অনবরত হর্ন দিচ্ছে, আশে পাশে লোকজন আটকা পড়েছে, বেশ বিচ্ছিরি একটা অবস্থা। অরুণিমার বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ লেগে যায়, ডানপাশের গাড়িটার জানালা দিয়ে যিনি মাথা বের করে ডাকছেন তিনি মুরশীদ স্যার।
ভিড় ঠেলে গাড়িতে উঠে দরজা লাগানোর সাথে সাথে অরুণিমার মনে হয় নিরব একটা জগতে ঢুকলো সে। মৃদু ভলিউমে গান চলছে। ‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে তোমার কাছে এসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে…’
ততক্ষণে বেশ ভিজেছে সে। অপরাধীর ভঙ্গিতে বলে ওঠে, আপনার গাড়ি তো ভিজিয়ে দিলাম। মুরশীদ স্যার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান তার দিকে, চুলের পাশ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে, একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা।
‘এভাবে চলাফেরা করেন নাকি রাস্তাঘাটে? এত অন্যমনষ্ক?’
জবাবে অরুণিমা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসে শুধু।
‘কতক্ষণ ধরে ডাকছি আপনাকে জানেন?’
অরুণিমা শুধু বলতে পারে, ‘স্যরি, আমি লক্ষ্য করিনি’। অথচ তার যে কী ভীষণ ভালো লাগছে! অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে একসাথে।
‘একটা কফি নিয়েছিলাম একটু আগে, দু-তিন সিপ খেয়েছি কেবল। ইচ্ছে করলে খেতে পারেন, গরম আছে এখনো। নয়ত যে অবস্থা করেছেন, ঠান্ডা লেগে যাবে আপনার’ স্টিয়ারিঙ-এ হাত রেখে সামনে তাকিয়ে বলেন মুরশীদ স্যার। জ্যাম থেকে ততক্ষণে বের হয়েছে তারা। গাড়ি চলছে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়।
স্যারের কথায় মনে পড়ে অরুণিমার, এর আগেও এক কাপে কফি খেয়েছে তারা। কাপটা নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই একটা হাঁচি দেয় সে। মুরশীদ স্যার সেই শব্দে চমকে গিয়ে হেসে ওঠেন।
‘বলেছিলাম তো?’ অরুণিমার দিকে ফিরতেই দেখলেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। হেসেই বললেন, ‘আপনি পা তুলে আরাম করে বসতে পারেন। সিট বেল্ট বাঁধতে হবে না’।
অরুণিমার চোখ ভিজে আসতে শুরু করেছে। সে হাঁটু ভাঁজ করে মুরশীদ স্যারের দিকে ঘুরে বসে কফির কাপ হাতে নেয়।
কোটের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরেন মুরশীদ স্যার।
কিছু মনে না করলে এটা দিয়ে এবার মাথা মুছে ফেলেন।
হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিতেই একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার চোখ থেকে। মুরশীদ স্যার অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘স্যরি অরুণিমা, ডিড আই ডু এনিথিং রং?’
কান্নার দমকে তার কোন প্রশ্নের উত্তরই অরুণিমা দিতে পারে না। কেবল মাথা নেড়ে না বলে। মুরশীদ স্যার কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতে ওয়াইপারের ওঠানামা দেখেন। জনহীন রাস্তার একপাশে গাড়িটা থামিয়ে অরুণিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখেন একহাতে। কাঁদুক মেয়েটা কিছুক্ষণ।
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। জানালার কাঁচ ঝাপসা। মুরশীদ স্যারের গাড়ির প্লেয়ারে বেজে যাচ্ছে,
…She may be the beauty or the beast
May be the famine or the feast
May turn each day into a Heaven or a Hell
She may be the mirror of my dreams
A smile reflected in a stream
She may not be what she may seem
Inside her shell…
১৭.
অরুণিমা
প্রিয়জনেষু,
দীর্ঘদিন পরে কাউকে লিখছি। যদিও এর মাঝে আপনি জেনে গেছেন তবু বলি, অনেকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজের অফার ছিলো। ভেতর থেকে যাবার তাগিদ পাচ্ছিলাম না। আপনার সাথে মেশা না হলে এই উৎসাহ পেতাম না। নতুন দায়িত্ব নিতেই মনস্থির করলাম শেষাবধি। বলতে পারেন পালিয়ে যাচ্ছি কিনা, তা একরকম পালানোই বটে। একটা বয়সের পর নিজের সব চাহিদাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে বাস্তবতা আর দায়িত্ব পথ আগলে দাঁড়ায়। আমি সেগুলো এড়াতে পারিনি। আবার নিজেকে নিয়ে ভয়ও ছিলো। খুব অর্ডিনারি মানুষ আমি, অরুণিমা।
আপনি আমার অনেক পছন্দের। আর অবশ্যই শ্রদ্ধার। ভালোবাসারও। অনেক সাহস নিয়ে সত্যি বলে ফেললাম। এই অনুভূতির ন্যায়-অন্যায় নিয়ে বিচারে যাবো না। তবে নিজের অনুভূতির প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছি সবসময়। আপনার মতো সাহসী না হতে পারলেও।
যে কথা বলতে চিঠি লিখছি, আপনার পাশে সবসময় আছি আমি। সশরীরে না হলেও আছি। শুধু দৃঢ় থেকে নিজেরটুকু করে যান। অনেকদূর যাবেন আপনি। আপনার মাঝে যে শক্তিশালী মানুষটা রয়েছে তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। যে কঠিন সময় পার করে এসেছেন তার অর্জনগুলোই শক্তি দেবে আপনাকে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আদনান আমার বন্ধু ছিলো। হ্যাঁ, আপনাদের সেই সময়ের কিছু কথা আমি জানি। অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে জিজ্ঞেস করব, আদনানের সাথে কী সম্পর্ক ছিলো আপনার, কিন্তু সংযত করেছি নিজেকে। আপনার উদারতার সামনে দাঁড়িয়ে অসম্মান করতে পারিনি।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, গোপনে কিছুটা গোয়েন্দাগিরিও করেছি আপনার ওপর। পলাশের ছোটবেলার অ্যাকসিডেন্টের কথা জেনেছি। তার বাবা-মা হারানোর কথা, সর্বোপরি তার শারীরিক অক্ষমতার কথাও আমার অজানা নয়। আবীরকে যে মমতায় আপনারা দুজন লালন করছেন, শ্রদ্ধা ছাড়া কীই বা জানাতে পারি, বলেন?
আপনার জানার কথা নয়, পলাশ আমার কাছে এসেছিলো। শুধু অনুরোধ করতে আমি যেন কোন দুঃখ না দেই আপনাকে। তার প্রস্তাব রাখার মতো পরিস্থিতি আমার ছিলো না। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সে-ই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি, যেমন আমার জন্য বীথি। বন্ধুত্বের মতো দৃঢ় কি আর কিছু হয়! তবে আমার মনে হয়েছে সে বড় ভঙ্গুর, আপনার মমতার আলিঙ্গনে তাকে বেঁধে রাখবেন।
জীবনের গল্পগুলো অন্যরকম করে লেখার আকাংক্ষা অনেকেরই থাকে। আমিও ব্যতিক্রম নই। নইলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আপনার-আমার আগে দেখা হলো না কেন, এ চিন্তা মাথায় আসতো না। তবে কিছু আফসোস শুধু অপ্রাপ্তি থেকে আসে না।
আরো অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। আমার অক্ষমতা, উপযুক্ত ভাষা জানা নেই। তাই প্রিয় গানের লাইন থেকে উদ্ধৃত করলাম,
She, who always seems so happy in a crowd
Whose eyes can be so private and so proud
No one’s allowed to see them when they cry
She may be the love that cannot hope to last
May come to me from shadows in the past
That I remember ’till the day I die
She maybe the reason I survive
The why and wherefore I’m alive
The one I’ll care for through the rough in many years
Me, I’ll take her laughter and her tears
And make them all my souvenirs
And where she goes I’ve got to be
The meaning of my life is
She…
শেষদিনে কোনরকম ভুল হয়ে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। শুধু ভালোলাগার স্মৃতিটুকুই রাখবেন, এটাই চাওয়া।
ভালোবাসা রইলো অরুণিমা।
মুরশীদ
১৮.
অরুণিমা হিথ্রো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছে। বাইরে প্রবল ঝড়, অনভ্যস্ত আবহাওয়ায় শরীর শীতে কাঁপছে তার। এককাপ কফি আর চিঠি নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসেছে। গত চার বছরে এই নিয়ে আজ তৃতীয়বারের মতো চিঠিটা পড়ছে সে। তবে একদিনের জন্যও হাতছাড়া করেনি, পরম যত্নে রেখেছে। ফটোকপি করে, মোবাইলে ছবি তুলে বিভিন্নভাবে রেখেছে নিজের কাছে, যেন কোনভাবেই হারাতে না হয়। অনেক টানা-পোড়েন এসেছে তার জীবনে। দুঃসময়গুলোতে স্যারের লাইনগুলো স্মরণ করেছে বার বার। আর স্মৃতিতে বহু যত্নে রেখেছে সেদিনের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার মুহূর্ত। যতবার চ্যালেঞ্জ এসেছে তার সামনে, মুরশীদ স্যারের সেদিনের শক্ত করে জড়িয়ে ধরা হাত তাকে শক্তি দিয়েছে। মুরশীদ স্যারের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই তার কাছে বিশেষ। তবে সেদিনেরটা অতুলনীয়।
বাসায় ফিরেছিলো অদ্ভুত ভালোলাগা আর শিহরণ নিয়ে। নিজেদের সামলে নিয়ে গাড়ি চলা শুরু হয়েছিলো যখন, মুরশীদ স্যার একহাতে তার হাত ধরে রেখেছিলেন পুরোটা পথ। আর অরুণিমা মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরায়নি তাঁর থেকে। আরাধ্য এই মানুষটাকে সত্যিই সে এভাবে পাবে তার ভাবনারও অতীত ছিলো তার। নামার মুহূর্তে মুরশীদ স্যার তার হাতটা একবার শুধু নিজের বুকের বামদিকে চেপে ধরেছিলেন। একটা কথাও কেউ কাউকে বলেনি আর। সেদিন। কোনদিন।
মুরশীদ স্যারের কথা পলাশকে কিছুই লুকায়নি অরুণিমা। স্যার চলে যাবার পর সব খুলে বলেছে। মুরশীদ স্যার এতোবড় সত্য কিভাবে বুঝলেন কে জানে, আসলেই পলাশ তার সবচেয়ে বড় শক্তি। ইউনিভার্সিটিতে আদনানের রুম থেকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অরুণিমা বের হয়ে পলাশকেই সামনে পেয়েছিলো। পলাশ তাকে বিপদের মুখে যেতে দেখে সেদিন ওখানে না গিয়ে পারেনি। অরুণিমা বের হয়ে এসে তাকে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, তুই, তুই আমাকে বিয়ে করবি?
পলাশ রাজী হয়নি প্রথমে। ছোটবেলায় অনেক বড় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো তার। বাবা-মা কেউ বাঁচেনি। সে প্রাণে বেঁচে গেলেও নিম্নাঙ্গে বড় ধরণের ইনজুরি ছিলো। ইন্টারনাল ইনজুরিও ছিলো। পলাশ জানতো সে অরুণিমাকে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন কখনোই দিতে পারবে না। অরুণিমা কোন কথা কানে তোলেনি। বিয়ে করেছিলো পলাশকে।
আবীরকে একটা হাসপাতালে পেয়েছিলো তারা। বাচ্চাটাকে কাপড়ে মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে গিয়েছিলো কেউ। অরুণিমা-পলাশ নিজেদের সবটুকু ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে আবীরকে। তবে পলাশ যে ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে এত কাছাকাছি থেকেও বোঝেনি অরুণিমা। পলাশের জীবনে অরুণিমাই ছিলো একমাত্র, তার কষ্ট সে মেনে নিতে পারেনি। অরুণিমার সব কষ্টের জন্য নিজেকেই দায়ী করতো। শেষপর্যন্ত পলাশকে ধরে রাখতে পারেনি অরুণিমা।
থানা থেকে পলাশের মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য তাকে যখন ডাকা হয়েছিলো, সে যায় নি। অরুণিমা ভালোবেসেছিল পলাশকে। ভালোবাসার মানুষের রেলে কাটা পড়া চেহারা সে দেখতে চায় নি। তবে পলাশের মৃত্যু তাকে নতুনভাবে কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে। যারা ডিপ্রেশনে ভোগে, আত্মহত্যাপ্রবণ, তাদের জন্য কাজ করা শুরু করে অরুণিমা। কী ধরনের কাউন্সেলিং দরকার, আর কী কী সাপোর্ট দরকার দিনরাত সেগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছে। এইসব গবেষণা নিয়েই একটা বই লিখে ফেলে একসময়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তার বইটা বেরুনোর কথা। তাদের আমন্ত্রণেই এখানে এসেছে সে।
লন্ডনের মাটিতে পা দেয়া মাত্রই তার বুকের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। যদিও মুরশীদ স্যারের কোন খোঁজ নেবার চেষ্টা সে করেনি, তবু সে জানে তিনি এখন লন্ডনে থাকেন। কথায় কথায় শামীম একদিন বলেছে তাকে। এও বলেছে অরুণিমার সব খবরই তিনি জানেন। অরুণিমা তো জানতোই তিনি ছায়া হয়ে তার সাথেই থাকবেন আজীবন।
এরকম ঝোড়ো সন্ধ্যাগুলো তার জীবনে বার বার হাহাকার নিয়ে এসেছে। অরুণিমা তার মা কে দেখেনি। মাতৃস্নেহে তাকে লালন করেছে যে বাবা, তাঁর মৃত্যু এমন এক দুর্যোগের রাতে। কতই বা বয়স ছিলো তার! স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি তখনো। মফস্বল শহরে তার আর তার দাদীর সামনে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি। পলাশও এমন এক রাত বেছে নিয়েছিলো। এত কিছুর পরও অরুণিমা আশা হারায়নি জীবনে।
অরুণিমার ভাবতে ভালো লাগে এয়ারপোর্টে এই এত মানুষের ভীড়ে মুরশীদ স্যারও আছেন কোথাও। দূর থেকে তাকে দেখে প্রথমে দৃষ্টিভ্রম মনে করবেন। ফের এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলবেন, ‘কী আশ্চর্য, অরুণিমা…’