ঠাকুরমার গরমজল খাওয়ার কেটলিটা অনেকদিন পড়ে আছে ঘরে। কেটলিটা অনেক পুরানো। বয়স কমছে কম একশ বছর পার হবে। দেশভাগ, স্বাধীনতা যুদ্ধ সব দুঃসময়ের স্বাক্ষী এই পিতলের কেটলি। এতদিনে তার রং বদল করে এখন ঠিক বোঝা যায় না এটা কোন ধাতুর তৈরী। কেটলির নল বাঁকা হয়ে গেছে, গায়ে ট্যাপ পড়েছে। ব্যবহার না করতে করতে ভেতরে বাইরে কল ধরে গেছে। ট্যাপ-চাপা খেয়ে পরিসরও ছোট হয়ে এসেছে। ভেতরটা সবুজাভ হয়ে আছে। তেল আর বালু দিয়ে ঘষা-মাজা করার পরও কেটলির রঙের কোন পরিবর্তন হয়নি। দু’দুবার রঙ ঝালাইটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তবুও এটি বহাল তবিয়তে ঘরের মধ্যে শোভা পায়। এরমধ্যে ঘরবাড়িতে বিপুল পরিবর্তনের মধ্যে এটা কিভাবে এতদিন টিকে থাকলো এটাও ভাবনার ব্যাপার। বাবার আমলের টিনের দোতালা ঘরে আমরা বড় হয়েছি। বনেদি ঘর ছিলো আমাদের। গ্রামে তিন চারখানা ঘরের মধ্যে একখানা ঘর আমাদের। শাল কাঠের খুটি ও টিন দিয়ে গড়া, ভেতর আলকাতরার পোচে কালোটা আরো চকচক করে। এর মধ্যেই মূল বনিয়াদি ভাবটা ফুটে ওঠে। আমরা সব ভাই-বোনেরা থাকার পরে অতিথী,আত্মীয়-স্বজন এলে অনায়াসে থাকতে পারতো। এক সময় এলাকার অর্থনীতি বদলাতে শুরু করলো। টিনশেড ঘরের প্রচলন শুরু হলো। টিনশেড অনেকটা নতুন জামাকাপড় পড়ার মতো। দেয়ালগুলোতে ইটের গাঁথুনি-ছাউনি টিনের। তবু ইট বলতে কথা। ইটের ভিতরে একটা বাদশাহী ব্যাপার আছে। কোথাও মাটি নেই। সবখানে সিমেন্ট! আহা কি দারুন বাড়ি এলো জমানায়! মাটিতেই পা-ই পড়ে না। কি দারুন গরমের দিনে ফ্লোর মুছে ফ্যান ছেড়ে ঘুমানোর মজাটাই আলাদা। কিন্তু জমিদার বাড়িগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় এ জায়গাটা একদম অন্যরকম। বাড়ির পুরোটাই ইটের গড়া, কেমন একটা সোঁদা গন্ধ আসে। তাছাড়া সুড়কি ওঠা দেয়ালগুলোতে ইটের কারুকাজ খুবই লক্ষ্যনীয়। আমাদের মাসির বাড়ি জমিদার বাড়ি ছিলো। আমাদের টিনশেড ঘর হয়েছে শুনে একদিন মাসি দেখতে আসলেন আমাদের নতুন ইটের ঘর । মাকে বললেন-
-ও তোরা তাহলে গরিবী দালান বানিয়েছিস?
মা কোন উত্তর না দিয়ে খুশী ও সরলতার সঙ্গে মাসিকে বললেন, বিকালটা থেকে যা দেখবি নীচটা মুছলে কত শান্তি। অনেক ঠাণ্ডা লাগে । আমার তো, গরম লাগে খুব। এখন বেশ ভালো আছি।
মাটির সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে কিভাবে ভালো থাকা যায় সেটা মায়ের মাথায় ঢুকতো না। তবু নতুন ঘর নতুন আমেজ ভালোই তো। এসব কথা শুনে মাসি একটু রেগেই বললেন-
-তোরা সুড়কির আর সিমেন্টের পার্থক্য বুঝিসনি। ধীরে ধীরে বুঝবি। একটা চুন-সুড়কির দালান করতে অনেক টাকা লাগে। আমার শ্বশুর জমিদার ছিলো বলে পেরেছেন। যাইহোক-তুই গরমের মৌসুমটা আমার বাড়ি চলে আয় দেখবি- চুন-সুড়কির জমিদার বাড়ির শান্তি কোথাও পাবি না।
মার মনটা যার পর নাই খারাপ হলো। ঠিক এ সময় মাসির চোখে পড়লো আলমীরার ভেতরে রাখা ঠাকুরমা‘র কেটলিটা। বয়সের ভাজে ন্যুব্জ কেটলি এটা নিয়ে এত টানা হেচড়া কিসের? বার বার অর্থনীতি বদলায়, বদলায় ঘর। বদলের সঙ্গে কত কি খোয়া গেল! কিন্তু এটা রয়ে গেছে যথারীতি, বাপ-ঠাকুর্দার আমলের পুরানো খড়গের মতো। মাসির চোখে এটা পড়তেই বললেন,
-তোদের দরিদ্র স্বভাব আর গেল না। এটাকে এখনো রেখেছিস কেন?
মা বলেন, – ওদের ঠাকুমার চিহ্ন তো তাই কেউ ফেলতে চায় না।
কেটলিটা কোন কাজে লাগে না। তবুও কেন যেন এটাকে কেউ অযত্ন করে না। এমনকি ওটার গায়ে পা লাগলে সবাই মাথায় হাত দিয়ে প্রনাম করে।
মাসি খুব রাগস্বরে বলে কেন?
ওদের বাবা শিখিয়েছে বড়দের স্মৃতিচিহ্নকে সম্মান করতে।
মাসি দাঁত খিচিয়ে ওঠেন – কেন? যতোসব আদিখ্যেতা। পুরানো জিনিসপত্রকে এভাবে আগলে রাখা এটা স্রেফ আদিখ্যেতা! মা বললেন আদিখ্যেতা হলেও কিছু করার নেই। ওদের বাবা একদিন এই কেটলি নিয়ে রাতে বসে ওদের বলেছেন- আমার বাবা যখোন মারা যায় তখন আমার বয়স মাত্র দশ বছর। আমার মা যে সংগ্রাম করে আমাকে বাঁচিয়েছে আমি তার ফসল । আমার মায়ের ব্যবহারিক অনেক কিছুই আমি সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। মা-বাবার চিহ্ন বলতে এই কেটলিটা শুধু রয়ে গেছে। কেটলি বলেই না। গুরুজনদের যেকোন স্মৃতিচিহ্নকে সংগ্রহ ও সম্মান করা একান্ত কর্তব্য। আশাকরি তোমরাও করবে।
মাসি বলে ওঠেন, – তোর শাশুড়ি কি খুব ভালো মানুষ ছিলেন? দেখতে কিন্তু খুবই কুৎসিত ছিলেন।
মা শান্তস্বরে বলেন – হোক না কুৎসিত, মানুষ তো! তার বাইরেটা দেখে মানুষকে বিচার করতে নেই। ভিতরটা দেখাই মনে হয় জরুরি।
মাসি বলেন- আমার শাশুড়ি দেখতে খুবই সুন্দর কিন্তু ব্যবহারেও জমিদারিভাব একদম রয়ে গেছে। কিন্তু যা ব্যবহার তাতে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না। এত বয়স তবু আছে তো দিব্যি। গেলেই বাঁচতাম। কিন্তু সে অক্ষয়! আমার চিতার ধোঁয়া না দেখে বিদেয় হবেন বলে মনে হয় না।
মাসি মূলত এসেছিলেন, আমাদের বাড়িতে নতুন ইটের দেয়াল গড়ে ওঠার কারণে। সবার ঘরে ইটের দেয়াল উঠবে- একখানা ইটের উপর নতুন ইট- এটা খুব ভালো কি? তার ভবনতো পুরানো হয়ে গেছে এ সময় এটা নতুন ভবন-ভাবাই যায় না। তাদের ভবন আগের মতো চকচকা করতে হলে সেটা নতুন করে মেরামত করা দরকার। তার জন্য দরকার লক্ষ লক্ষ টাকা। এত টাকা এখন কোথায়? টাকা না থাকুক তাই কেউ তার প্রতিযোগিতায় আসবে এটা মানতে ভীষণ কষ্টই হচ্ছে। দেয়াল সব সময় দেয়াল সৃষ্টি করে সেটা ইটেরই হোক আর মাটিরই হোক- এটা মাসির জানা। তাই তার এটা ভালো লাগেনি একদম।
মা বলেন- আমাদের ভবন তো তোদের মতো অত বিশাল নয়। তোর বাড়ি ভাওয়াল রাজার বাড়ির থেকে কোন অংশে কম নয়। বাড়ির ইটগুলো মনে হয় কথা বলে। এমন ভবন একটাও করতে পারবে কেউ! এটা বললে মাসির কষ্ট খানিকটা লাঘব হবে ভাবলেও আসলে তা হয় না।
অজস্র স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামন্ত কালের স্মৃতিময় জমিদার বাড়ির ভবন। কত বড় এলাকা জুড়ে এই বাড়ি। এই এলাকায় এমন জমিদার বাড়ি আর একটাও আছে? এর ভিতরে বিশাল আটচালা। উপরে সব কোঠাগুলোর দুয়ারের সামনে পিতলের রেলিং দেয়া। মূলত যেসব অনুষ্ঠান জমিদাররা করতো সেটা মেয়েদের দেখার জন্য দেতলার এতবড় এলাকা জুড়ে মজবুত রেলিংঘেরা। অযত্ন অবহেলায় সেগুলোতে জং ধরে এখন ভিন্ন আকার নিয়েছে। তবু জমিদারি বুনিয়াদ বোঝা যায়। কোলকাতা থেকে দল এনে এখানে নাটক করা হতো, গান বাদ্য কত কি হতো! জমিদারদের মনস্তত্ত্ব ছিলো একদম আলাদা। তারা কিভাবে জমিদার হয়েছে সেটা তারা তো জানত। ব্রিটিশ বেনিয়াদের খুশী করে ভূমির অধিকার নিয়ে প্রজাদের থেকে বাৎসরিক খাজনা নেয়াটাই ছিলো কাজ। জমিদারদের অত্যাচার ছিলো ভয়াবহ। মাসির বাড়ির আটচালা দেখলে মনে হয় এখানে কত লোকের কান্না লুক্কায়িত আছে। এই প্রথা দেশভাগের পরে রদ হলেও যেসব ক্ষত এখনো দেখা যায় সেসব ভ্রুক্ষেপ করবে কে? জমিদারদের বিলাসবহুল জীবন কাহিনী মাসি জানতেন । ক্ষয়িষ্ণু জমিদার হলেও আমার মাসি চাইতেন না তার সমকক্ষ কেউ হোক। কারও ঘরে ইটের দেয়ালের সঙ্গে তিনি আরেক দেয়ালের সমান্তরালে বাস করতে চাইতেন না। আমার মাসির শ্বশুরের জমিদারি কেনার গল্প মাসি জানতেন। সে কাহিনির জন্য কোন আত্মশ্লাঘা তার ভিতরে কাজ করতে কিনা বোঝা যায় না। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসে এতসব পাওয়ার ধাক্কা সামলানো খুব কষ্টের। কিন্তু মাসির আচরণে তার সামান্য প্রভাব পড়তো না। তিনি জমিদারির পূর্ণ বয়স না পেলেও ব্যবহারটা ভালো করে রপ্ত করেছিলেন।
এই সুবর্ন নগরে রমানাথ চৌধুরীর নাম কে না জানে? তার কথায় বাঘে মহিষে এক সময় এক ঘাটে জল খেতো। ছিলো পাইক বরকন্দাজ ,অজস্র কাজের লোক, অঢেল সম্পত্তি। ধানের মৌসুমে ধান রাখার জায়গা থাকতো না। তারপরে বাৎসরিক খাজনার সময় তো বিশাল আয়োজন চলতো। কিন্তু সব জমিদারের মতো তারও প্রজা বিদ্রোহের ভয় ছিল। তাদের বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকতো । সব অনুষ্ঠানে প্রজারা আসতো-নাচতো গাইতো ভালো থাকত। দূর্গা পূজায় মহিষ বলি হতো। প্রজারা আনন্দ-ফুর্তি মধ্য দিয়ে শোষণ-বঞ্চনা ভুলে থাকতো। রমানাথের জমিদারি এমন হলেও অরো অনেক কাহিনি লুকায়িত আছে তার জীবন কাহিনিতে। সেসব এখনও এলাকার মানুষ ফিসফিসিয়ে বলে, প্রথমে তারা ছিলো পূজারী ব্রাহ্মণ। রমানাথের ভগ্নিপতি তখন ভারতে টাকশালে চাকরি করতো। টাকশাল থেকে রমানাথ কোনভাবে টাকা এনে সুবর্ন নগরের সিকি অংশ জমিদারি কিনে ফেলে। অল্প দিনের মধ্যেই বিশাল এলাকা নিয়ে ভবন করেন। দীঘি খুড়ে করেন বড় ঘাটলা । গোলাঘর থেকে কতকিছু। তারপর তিনি হয়ে ওঠেন রমা ঠাকুর থেকে জমিদার বাবু রাম নাথ চৌধুরী। এরমধ্যেই তার ভগ্নিপতি অর্থ আত্মসাৎ মামলায় জড়িয়ে পড়েন। বিচারে তার ফাঁসি হয়েছিলো। রামনাথের বোন স্বামীর ফাঁসির খবর শুনে পাগল হয়ে যান। নতুন ওই ভবনে তিনি থাকতেন, শুধু কাঁদতেন- কিছু খেতেন না। সারারাত চিৎকার করতে করতে – কখনও ছাদে উঠে যেতেন। চিৎকার করে বলতেন আমার স্বামীকে কেন, এই নব্য জমিদারকে ফাঁসি দাও—-। তার এই চিৎকার রাতের নিরবতা চিড়ে দূর গ্রাম – যেখানে মানুষ কেরোসিনের কুপি জেলে বাস করেন সে পর্যন্ত চলে যেত। একদিন স্বামীর শোকে তার মৃত্যু হলে রামনাথ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। নতুবা প্রজারা এসব কাহিনি জনে জনে জেনে যাচ্ছিলো। জমিদারি প্রথার ইতি টানতে টানতে রমানাথের মৃত্যু হয়। তারপর তার সন্তান রামানন্দ কোন কাজই করতো না। জমিদারি বেঁচে খেত। তার এই বেঁচা কেনার নিয়ম রীতিতে অনেকেই জমিদার হয়েছে।
একটা জায়গা দেখিয়ে ৫০/১০০ টাকা নিতে নিতে জায়গার মালিক কবে অন্য লোক হয়ে যেত তিনি টের পেতেন না। এছাড়াও একই জায়গা কয়েক জনকে দেয়ার জন্য কত রক্ত ঝরেছে মাটিতে। তারপরও তারা জমিদার। তাদের সঙ্গে অন্য সবার ভিতরে এক অদৃশ্য দেয়াল আছে। যে দেয়াল কোন কালেই ভেদ করার মতো নয়।তাদের অভাব দেখা দিলেও একথা ভুলেও কেউ কাউকে বলতো না এমন কি বাচ্চারাও না। কারণ তারা জমিদার। তাদের ইট-সুড়কির জমিদারি রাজাবাড়ির ন্যাংটা ঘোড়ার অবস্থায় এলেও মন-মানসিকতায় যেমন জমিদার ছিলো তেমনি তাদের প্রজারা হত দরিদ্র জমিদারের সঙ্গে প্রজার মতো কথাই বলতেন । শুধু কি তাই? জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বাড়ির দিকে ফিরে প্রণাম করতেন। বয়বৃদ্ধরা ওই বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মেলে বা জুতা পায়ে হেঁটে যেত না। জমিদারি চলে যাওয়ার বহকাল পরেও দরিদ্র প্রজাদের ভিতরে জমিদারি শাসন টিকে ছিলো। যে কারণে বৃষ্টি নামলে ছাদ চুয়ে জল পড়ে সব ভিজে যেত । আমার মাসি একথা কখনো বলতো না। মান-সম্মান বলে কথা। জমিদার বাড়ির বউ আমার মাসি-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব রাখলেও এ নিয়ে আমার মায়ের কোন হাপিত্যেশ ছিলো না। মা সময় পেলেই বসে পুরানো কেটলিতে তেতুল লাগিয়ে বালু দিয়ে মাজতেন। এটা মাসিকে খুব পীড়িত করতো।
মাসি খুব রাগ হয়ে মাকে বলতো এটা ফেলে দিস না কেন? মা শান্ত স্বরে বলতেন- ওদের ঠাকুমার স্মৃতি কিভাবে ফেলে দেই। আমার ছেলে-মেয়েরা ওর ঠাকুর মার খুব ভক্ত। ওরা কষ্ট পাবে। মাসি এসব কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে যেত। ঠাকুরমার মানবিক ও জীবন সংগ্রামের কথা বিবেচনা না করেই সোজা বলে দিতেন- ইস তোর শ্বাশুড়ি কি কুৎসিত ছিলো না দেখতে! একদম বিশ্রী রকমের, তার উপরে তামাক মুখে রাখতো, কথা বলার সময় কি উৎকট গন্ধ বেরুতো!
মা বলতেন- হোক না-এভাবে বলতে নেই। ওদের ঠাকুর মা ওদের জন্য অন্তঃপ্রাণ ছিল। মাসি বলতেন,
-সব শাশুড়িগুলো বউদের একদম জ্বালিয়ে মারে। এটা করো ওটা করো-এসব ভালো লাগতো তোর? মা এসব কথায় রাগ হতেন কিনা বোঝার বয়স আমার ছিলো না। শান্ত মেজাজে বলতেন,
– তার ছেলের বউকে তো বলবেই, মেয়ে থাকলে হয়তো বলতো না। এ কথায় যেন মাসির গায়ে গরম জল পড়লো । ভীষণ ক্ষেপে গেলেন আমার মাসি। সেদিন আর বেশি সময় থাকলেন না। রাগে গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন । যাওয়ার সময় মাকে কেটলিটা ফেলে দিতে বললেন।
মাসিদের জমিতে ধান হয়নি সেবার। এলাকায় অভাব। এরমধ্যে এলো জামাই ষষ্ঠী। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জামাই-মেয়ের কল্যাণে এই ব্রত পালন করে। আমরা ভাই-বোনেরা নৌকায় উঠলাম। বাজার থেকে বাবা সাধ্যমতো কিনলেন জামাই ষষ্ঠীর উপাচার-আম-কাঁঠাল-মিষ্টি, দিদিমার জন্য শাড়ি ইত্যাদি। নিয়ম মতো আমরা সব নৌকায় তুলে নিয়ে রওয়ানা হলাম মামাবাড়ির উদ্দেশে। ওটাই ছিলো আমাদেও শৈশবে ভ্রমণের একমাত্র দিন। পড়াশুনা বাদ দিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে আমাদের নৌকা চলতে শুরু করতো। খাল, নদী, গ্রাম-গ্রাম্য জীবন পেরিয়ে চলতো আমাদের নৌকা । খালের দু’পাশে কত শত গ্রাম, গোলপাতার ছাউনির ঘর-কোথাওবা টিনের চালে রোদ লেগে জ্বলে উঠতো চোখের আনন্দ। প্রাণ ভরে মানুষ দেখতাম। খালের ভিতর মানুষের স্নান, দূর গাঁয়ের দৃশ্য, খালের ঘাটে সংসারি নারীদের ধোয়া-পাখলার কাজ, কিশোর কিশোরীদের ডুব-সাতার, রাস্তার হাটুরে মানুষ, তাদের পথ চলাসহ কত প্রাণ জুড়ানো সব দৃশ্য। খালের পাড়ে ঘাট থেকে সবাই চেয়ে দেখতো আমাদের মামাবাড়ি যাওয়ার উচ্ছ্বাস। নৌকা ঢ্যাপ কচুরির বুক চিড়ে যেতে যেতে চোখে পড়তো হাসেদের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে খালে-ডুব দিয়ে কাবার খাচ্ছে ছো মেরে মুরগীর বাচ্চা নিয়ে উধাও চিল- বহুলোকের জটলা দেখতে দেখতে দৃশ্য যেন ফুরাতো না। খালপাড়ে গরুর গোয়াল, দুধ দোহাতে ব্যস্ত কেউ, হরেক রকমের নৌকা-রঙিন পাল তুলে যায় দূরদেশে। খালের পথ দৃশ্য দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যেত। খাল শেষ হতেই মধূমতি নদী। নৌকা মধুমতি নদীতে পড়তেই মা বলতেন সব চুপ, একদম নড়বে না। মধুমতির শান্ত ঢেউয়ের দোলায় দুলতো নৌকা। পাশেই ভেসে উঠতো অজস্র শুশুক। নদী পার হয়ে বিলের ভিতরে ধানক্ষেতের বুক চিড়ে চলতো নৌকা। নানারকমের ঘাস ফড়িং, নাম না জানা পতঙ্গ ছুটে আসতো । আমাদের গায়ে এস বসে আবার চলে যেত। এভাবে একসময় পথ ফুরিয়ে যেত। তারপরেই দেখা মিলতো মামাবাড়ির ঘাটের। আমরা কাউকে দেখার আগেই মামারা –মাসিরা সব ছুটে আসতো। এত আনন্দের দৃশ্য আমি কোথাও দেখিনি। সব সময় মাসিদের নৌকা আগেই পৌঁছে যেত। তাদের নৌকায় কত খাবার, খাসি থেকে মিষ্টি আম কাঁঠাল সব। জমিদারদের সঙ্গে এই বৈষম্যে দেখতে দেখতে আমরা বড়ো হচ্ছিলাম। জামাই ষষ্ঠীর বিশাল আয়োজনের মধ্যেও মায়ের সঙ্গে মাসির এক কথা…
– কেটলিটা তোরা রাখছিস কেন? । এই আবর্জনা ফেলে দে।
মা একই কথা বলেন। ওদের ঠাকুরমার স্মৃতিচিহ্ন এটা ফেলে দেই কিভাবে?
এবারে আমরা ভাবতে শুরু করি এই কেটলি নিয়ে মাসির এত মাথা ব্যাথা কেন?
২.
আমাদের এলাকার হরিহর বৈদ্য। আমরা হরি কাকা বলতাম। ছোট খাট মানুষ, বয়স আশির কোঠা পেরিয়ে গেছে। ঝাড়-ফুঁক করতেন জণ্ডিজের চিকিৎসায় ছিলেন পারদর্শী। এ ছাড়াও কারো কিছু চুরি হলে তুলা রাশির জাতক দিয়ে বাটি চালান দিতেন, চোরকে চিহ্নিত করতেন। বিভিন্ন রকমের তাকতুক করে সংসার চালাতেন। শনি-মঙ্গলবারে হরি কাকা ভাড়ে পড়তেন- মা কালি তার উপর ভর করতো বলেই এলাকাবাসী জানত। সবার ভিতরে কথা বলে দিতে পারতেন তার চোখ দেখেই। এতে কারো উপকার হয়েছে কিনা জানি না। তবে সবাই তাকে ডাকতো। তার জণ্ডিস চিকিৎসার ছিলো বিশেষ পদ্ধতি। চুনের জল নিয়ে যেতে হবে। যাওয়ার আগে তাকে বলতে হবে। পাকা জণ্ডিস হলে ভালো হবে না। কাঁচাটা হলে ভালো হবে। হরিহর কাকা সবার বাড়ির হাড়ির খবর জানতেন, এটাই তার চিকিৎসায় খুব কাজ দিতো বলে মনে হয়।। তার বিভিন্ন চালানের জোরে ভুত চলে আসত। একটা শতাব্দি কাল বসে দেখেছেন বহুকিছু।
একদিন তাকে ডেকে বলি কাকা, আমার ঠাকুরমা সুভাষিনী দেবী, এই কেটলিটা কেন আগলে রাখতেন? আর জমিদারদের এটা নিয়ে এত সংশয় কিসের? তিনি অনেক ভেবে বললেন শনি বা মঙ্গলবার কেটলি চালান দিতে হবে। কেটলি সব বলবে আমার মুখ দিয়ে শুনতে পারবে। তবে দক্ষিণা বিশ টাকা। আমরা রাজী হলাম। শনিবার রাতে বাড়ি ভর্তি লোকজন। কেটলির কথা শুনতে এসছেন। হরি কাকা গেরুয়া পোশাক পরে কপালে সিদূরের টান দিয়ে উঠোনে আসনে বসলেন । তার সঙ্গে এস বসলেন দুই সহযোগী। বসেই দুজন বললেন, এক কলসী জল আর একটা ঘটি লাগবে, লাগবে সিঁদুর। তারপর সিঁদুর ঘটে ও কেটলিতে মাখিয়ে হরি কাকা প্রথমে বৃত্ত কেটে ঘুরে ঘুরে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। তারপর বসে ঢুলতে ঢুলতে মাটিতে পড়ে গেলেন। এবার তার সঙ্গেও লোকজন কেটলী তার মুখের কাছে ধরলেন। হরিকাকা বলতে শুরু করলো কেটলির বৃত্তান্ত।
আমি সামান্য একটা কেটলী। পিতলের গড়ন। আমি ছিলাম তালমার জাগ্রত মন্দিরে। সেই খানের মন্দিরের মা কালী ওখানের জমিদারের মেয়ের রূপ ধরে গিয়েছিলেন ফুলের বাগানে। বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো এক শাখারী আর এক চাদর বিক্রেতা। জমিদারের মেয়ে তাদের থেকে শাখা আর নতুন চাদর কেনেন। টাকা চাইলে বলেন,আমি জমিদার কন্যা। জমিদারের কাছ থেকে গিয়ে টাকা নাও। এই বলে মা আসলেন তার মন্দিরে। এদিকে চাদর আর শাখা ব্যবসায়ী দুজনই গেলেন জমিদারের কাছে। জমিদারকে বললেন তার মেয়ে চাদর আর শাখা কিনেছেন। জমিদার বললেন আমিতো নিঃসন্তান। আমার কোন সন্তান নেই। পরে সবাই মেয়েটিকে খুঁজতে খুঁজতে মন্দিরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো মা কালীর হাতে নতুন শাখা, গায়ে নতুন চাদর। জিভ কামড়ে ধরা মা -পায়ের নীচে মহাদেব- সব যেন চকচক করছে , একটুকাল আগে যা বিক্রি হয়েছে সব তার কাছে দৃশ্যমান। এর মধ্যে বাড়ি থেকে খবর আসলো জমিদারের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হয়েছেন। শুনে উঠোনে উপস্থিত সবাই আবেগে চিৎকার করে বলতে লাগলেন- জয় মা কালী, কালী মায় কি-জয়।
আবার সুশীল কাকা কেটলির কথা বলতে শুরু করলেন। জমিদার বিস্মিত হয়ে বড় করে কালী পূজার আয়োজন করলেন। কিন্তু ভালো পুরোহিত দুজন লাগবে। পরে সুবর্নণগর থেকে জিতেন ঠাকুর আর রমা ঠাকুর গেলেন। তাদের পূজায় খুশী হয়ে জমিদার আমাদের দুটো দু’জন পুজারী ব্রাহ্মণকে দিলেন। আসার পথে রমানাথ ভাবলেন এটাতে তার কোন কাজ হবে না । তিনি বেঁচে দেবে চিন্তা করলেন। তখন কেটলিটা জিতেন ঠাকুর কিনে রাখেন। জিতেন ঠাকুর এতে গরম জল খেতেন। একসময় তিনি কোলকাতার বেলঘড়িয়া চলে যান একটা কেটলি নিয়ে । দেশভাগের পরে ওই কেটলিটা সেখানেই রয়ে যায়। আর একটা রয়ে যায় তার বাড়িতে। রমানাথ যে প্রতাপশালী জমিদার ছিলো তিনি এই কেটলি দেখলে তার মুছে যাওয়া দিনের কথা ভেবে বিরক্ত হতেন। জিতেন ঠাকুর এটা তার স্ত্রী সুভাষিনীকে বলেছিলেন। রমানাথের জমিদারির শংকা ছিলো এই কেটলি। প্রজাদের বড় বড় বিচারে এটা নিয়ে গেলে সেদিন বিচার হতো না। কেটলি দেখলেই জমিদার বাবুর মুখ কেমন পাংশুটে হয়ে যেত। এই কেটলীর বয়স অনেক । এটা কথা বলে। সবাই এর ভাষা বোঝে না। জমিদাররা বোঝে বলে ভয় পায়। বলে হরিহর কাকা এবার চুপ হয়। তার চোখে মুখে জল ছিঠালে সে উঠে বসে। উপস্থিত সবাই একজনে আরেকজনের দিকে তাকায়। এভাবে আসর শেষ হয়।
পুরানো কেটলি দেখলে ইতিহাস ফিরে আসে, তার ভয় হয়। টাকশালের টাকা,জমিদার বনে যাওয়া,প্রজা নিপীড়ন ফেলে আসা সাধারণ জাজনিক জীবন। এ কথা মাকে বলেছিলেন আমার ঠাকুরমা। মা কেটলিটাকে কখনোই ফেলে দেননি। কেটলিটা এখনো আছে বহাল তবিয়তে। কেটলি কথা বলে। জমিদার সেকথা বুঝতেন। আমরা বুঝিনা- শুধু বুঝি আমার বাবাকে বড় করতে আমার ঠাকুরমার বিশাল সংগ্রাম। যেটা পরে বাবাও করেছেন আমাদের বড় করতে। আমরাও সে পথেই আছি।