বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আর বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে বেশ এগিয়ে আছে। নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর চাকরি-বাকরির ক্ষেত্র যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে সন্দেহ নেই। তবে এতোসব অর্জনের পরও একটি পিছিয়ে থাকা দিক হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্য বা নারী- পুরুষের ভেদাভেদ। এই ক্ষেত্রটির উন্নতি ঘটলে বাংলাদেশ অতি দ্রুত উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে যেতে পারে। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, নারী-পুরুষের সমান অধিকার আছে বলে দাবি করা হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই এখনো মনে প্রাণে এ চেতনা ধারণ করে না বা- বিশ্বাসও করে না। আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান অতীতের থেকে অনেক এগিয়ে গেলেও মানুষের মন থেকে এখনো লিঙ্গ বৈষম্য দূর হয়নি। শিক্ষার্থীদের কথাই ধরা যাক। যে কোন পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন বা গ্রেডশিট সার্টিফিকেট, জন্ম সনদপত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যসূচক একটি ছক পূরণ করতে হয়। যখন একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে তখন তাকে মানুষ নয় বরং নারী অথবা পুরুষ জাতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তখন থেকেই জন্ম সনদপত্রের নারী- পুরুষ হকটি পূরণ করতে হয় এই জন্য যে নারীকে নারীসুলভ অবলা এবং পুরুষকে প্রভুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, চাকরি ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে তাকে ওই বৈষম্যসূচক ছকটি পূরণ করতে হয়। কি প্রয়োজন এর? কারো পরিচয় দেয়ার জন্য তার নামই কি যথেষ্ট নয়? কেন শিক্ষার্থীদের ‘হাম’ ও ‘ছাত্রী হিসেবে আলাদা করা প্রয়োজন? দেশ কি তবে মারী ও পুরুষের কাছ থেকে লিঙ্গ ভেদে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা আচরণ ও যোগ্যতা চায়? প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই বৈষম্যবাদী মানসিকতা প্রতিনিয়ত বহন করে চলেছেন শিক্ষারত শিক্ষার্থীরা ও উচ্চ শিক্ষা দানকারী শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিক্ষার্থী নর লিঙ্গ তেনে ‘ছাত্র’ ও ‘ছাত্রী’ মনে করে।
দেশকে ভালোবাসলে, দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে চাইলে বৈষম্যবাদী, রক্ষণশীল মানসিকতা পরিহার করার শপথ নিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য। অবসানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আনো সমান শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা দান হয় লিঙ্গভেদে। ছাত্র- ছাত্রী হিসেবে। অনেক বৈষম্যবাদী শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্রীরা হাস অপেক্ষা কম সুবিধা পাচ্ছে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে। শিক্ষকদের মধ্যে যদি এমন বৈষম্যবাদী মানসিকতা থাকে তাহলে কিভাবে শিক্ষা সুষম হবে? আর কি করেই উন্নতির চাকা ঘুরবে?
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলে ছাত্র হলের সময় সীমা উন্মুক্ত এবং উন্মুক্ত তাদের শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ। কিন্তু ছাত্রী হলের কঠোর নিয়ম- কানুনগুলো এমনটাই বোঝায় যে মেয়েরা যেন জেলখানার “করেনি। তাদের নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে হলে প্রবেশ করতে হবে, উপস্থিতির স্বাক্ষর করতে হবে। আর এর মাধ্যমে বারবার প্রমাণ হচ্ছে মেয়েরা ছেলেদের থেকে আলাদা।
যদি বলা হয়, এসব নিয়ম নারীদের ভালোর জন্য, নিরাপত্তার জন্য তবে এমন একটা প্রশ্ন তো চলে আসে- নারীর নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী কে বা কারা ? কোনো বনের হিংস্র জানোয়ার, নাকি সমাজের কোনো মানুষরূপী জানোয়ার? এ প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন নয়। তারা অবশ্যই আমাদের সমাজে লুকিয়ে থাকা মানুষরূপী জানোয়ার যারা নারীদের জন্য সমাজকে অনিরাপদ করে তুলছে। সন্দেহ নেই, আমাদের সমাজে দায়িত্বশীল, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন পিতা আছেন, ভাই আছেন, বন্ধু আছেন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন আসে, নারীরা কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে ? কেন কোনো মানুষরূপী হিংস্র জানোয়ারের স্তরে নারীকে তটস্থ থাকতে হবে?
লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার নারী সমাজের কাছ থেকে পুরুষের সমান উন্নতি আশা করা যায় না। সমাজে সমান অংশগ্রহণ না থাকলে নারীরা পরিবার, সমাজ বা দেশের উন্নয়নে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে পারে না। এটিই স্বাভাবিক।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা বোঝা হয়েই থাকে। সবার করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হয় তাদের। এই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। মুখে নারী-পুরুষ সমানাধিকার বলব, কিন্তু বাস্তবে তাদেরকে পদানত রাখব- এই মানসিকতা অবশ্যই পুরুষদের ত্যাগ করতে হবে।
সকল সরকারি কাগজপত্রে কেন ‘স্বামী/পিতার নাম:- এই অংশটি থাকে? এতে কি প্রমাণিত হয় না যে নারীরা স্বাবলম্বী না পরনির্ভরশীল? কেন সেখানে থাকে না ‘স্ত্রী/মাতার নাম’ এমন কিছু ? যাতে বোঝা যায় পুরুষেরাও নারীর উপর নির্ভরশীল। ধনি- .এমনটা হতো তাহলে পুরুষেরা অবশ্যই তাদের কল্পনার মিথ্যে রাজত্বের প্রভূ হয়ে এক সিঁড়ি নিচে মনে করতো নিজেদের। সমাজে নারীরা যাতে যথাযথ মর্যাদা পায়, পরিবারে বা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পায় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সাথে সমাজের শিক্ষিত ও বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের অবস্থা কেন খারাপ এই প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে। সর্বার্থে নিজের পরিবারকে ঠিক করতে হবে। মানবতাই। প্রধান ধর্ম- এই শিক্ষা সন্তানকে দিতে হবে। অপরদিকে, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বৈষম্যহীন শিক্ষাদান করতে হবে। কারণ, শিক্ষকই তো আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর। দেশকে ভালোবাসলে, দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে চাইলে বৈষম্যবাদী, রক্ষণশীল মানসিকতা পরিহার করার শপথ নিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য। অবসানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।