ভীমরাও রামজি আম্বেদকর যিনি বাবা সাহেব আম্বেদকর নামেও পরিচিত ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল আম্বেদকর মধ্যপ্রদেশের ছোটমৌ শহরে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা রামজি সকপাল ছিলেন মৌ সোনা নিবাসী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছোটোবেলা থেকে অত্যন্ত কঠিন জীবন সংগ্রামে অংশ নিয়ে সফলতা অর্জন করতে হয়েছে তাঁকে। আম্বেদকর ছিলেন নিম্নজাতের অর্থাৎ দলিত পরিবারের সন্তান। তখনকার সমাজে নিচু জাতের মানুষদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হতো। আম্বেদকর ছয় বছর বয়সে তাঁর মাকে হারান। এরপর তাঁর একমাত্র বিধবা পিসি মীরাবাই এই মাতৃহারা ছেলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি আম্বেদকরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর নিজের চেষ্টায় আম্বেদকরকে প্রাথমিক পাঠদান সম্পন্ন করিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরেও আম্বেদকর যত জায়গাতেই গেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য জাতিভেদ প্রথার করাল ছায়া সর্বদা তাঁর সঙ্গে লেগেই থাকতো। এমনকী তিনি যে স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন সেই স্কুলের পরিবেশও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। স্কুলের অন্যান্য সকল ছাত্ররা যেখানে বসত সেখানে তিনি সকলের সঙ্গে একসাথে বসতে পারতেন না। পাছে তাঁর ছোঁয়া লেগে অন্যের জাত চলে যায়। এমনকী শিক্ষক মহাশয়রাও তাঁর পড়া দেখতেন দূর থেকে ওই জাত যাওয়ারই ভয়ে। বিদ্যালয়ের কল থেকে জল খাওয়ার তার কোনো অধিকার ছিল না। আর এই অস্পৃশ্যতার ভয়ে তৎকালিন ভারতে কোনো নিচু জাতের ছেলে বিদ্যালয়ে যেতে চাইতো না।
১৯০৭ সালে আম্বেদকর উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাশ করেন। আম্বেদকর ছিলেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে খুশির কারণ। যে সময়ে নিচু জাতির মানুষের পড়াশোনারই অধিকার ছিল না সে যুগে উচ্চ বিদ্যালয় পাশ করা কোনো সহজ ব্যাপার ছিল না। এরপর ১৯১২ সালে আম্বেদকর অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে যান। সেখানে Colombia University-তে ভর্তি হন। এবং ১৯১৬ সালে M.A ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি “Evolution of Province Finance in British India” বিষয়ের উপর Ph.D ডিগ্রি লাভ করেন। এই বছরেই তিনি আইন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনার জন্য লন্ডনে চলে আসেন। সেখানে তিনি London school at Economics পড়াশুনা শুরু করেন। এরপর ১৯২৩ সালে তিনি এখানের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি দেশবাসীর জন্য নিয়োজিত প্রাণ হন। সেই সময়ে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যোগ দেন।
বাবা সাহেবের মতে অস্পৃশ্য প্রথার জন্ম হয় ৪০০ খ্রিস্টাব্দে। এর পর ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির আধিপত্যে এই অস্পৃশ্য প্রথার এমন অগ্রসরমান রূপ দেখা যায়।
১৯২৬ সালে আম্বেদকর বোম্বাই বিধানসভা পরিষদের সদস্য হন। সেই সময় তিনি ভারত ভাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। তিনি ভারতবর্ষকে অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীন হতে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই ভারত আর পাকিস্তান পাকাপাকিভাবে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর আম্বেদকর ভারত সরকারের আইন বিভাগের দায়িত্ব পান। এর পর তিনি নিজের চেষ্টায় একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির কয়েকজন সদস্য এবং আম্বেদকর নিজে ১৪১ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে পৃথিবীর বৃহত্তম সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিলেন। যা অনেক বিচার বিবেচনার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান হিসেবে সারা দেশে ঘোষণা করা হয়।
ঋক্ বেদ হিন্দু সমাজের অমূল্য সম্পদ। আর এই ঋক্ বেদ থেকেই হিন্দু সমাজের মানুষজন জ্ঞাত হয় চতুবর্ণের বিভেদ। যদিও ঋক্ বেদে বর্ণ ভেদ বর্ণিত হয়েছিল সামাজিক সুযোগ সুবিধার জন্যই। তবুও সমাজের কিছু উচ্চ বর্ণের মানুষ সামাজিক বৈষম্য ভেদে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষদের এই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে থাকে। দিনের পর দিন তারা শোষিত হতে থাকে সমাজের উচ্চ বর্ণের মানুষের দ্বারা। শোষিত হতে হতে এক সময় তারা শারীরিক ও মানসিক ভাবেও দুর্বল হয়ে পরে। আর ধীরে ধীরে তারা সমাজ থেকে আরও পিছিয়ে পড়তে থাকে। সমাজ এই নিম্ন বর্ণের মানুষদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক এই তিন দিক থেকেই শোষণ করতে থাকে। তাদের শিক্ষা অধিকার ছিল না। ছিল না সমাজে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার। দলিত ইতিহাসের এই করুণ কাহিনি শুধু এ যুগের নয়। প্রাচীন সভ্যতা থেকেই দলিতদের এই করুণ ইতিহাস লক্ষণীয়। সেই চর্যাপদের যুগ থেকেই সমাজ থেকে গ্রাম থেকে দূরে দলিতদের অবস্থান। সমাজের ভিতরে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানারকম বিধি নিষেধ দলিতদের উপর আরোপ করা হয়ে আসছে। বাবা সাহেবের মতে অস্পৃশ্য প্রথার জন্ম হয় ৪০০ খ্রিস্টাব্দে। এর পর ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির আধিপত্যে এই অস্পৃশ্য প্রথার এমন অগ্রসরমান রূপ দেখা যায়।
তিনি কিছু ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দ্বারা বোধিসত্ত্ব সম্মানেও সম্মানিত হয়েছিলেন। যদিও তিনি নিজেকে কখনও বোধিসত্ত্ব হিসেবে দাবি করেননি।
হিন্দু হল ভারতের বহু প্রাচীন একটি সংস্কৃতি। বলা হয় বহু যুগ আগে সিন্ধু নদীর তীরে যে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতার মানুষদের হিন্দু বলা হতো। যদিও এ বিষয়ের দ্বিমত আছে। সুপ্রাচীন কালে এই হিন্দু সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল সমাজের মানুষের নৈতিকতাপূর্ণ ভাবে চলার পথ প্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু পরবর্তী কালে এই হিন্দু সংস্কৃতির দর্শনের ছয়টি বিভাগের উৎপত্তি হয়। প্রাচীন ভারতে উদ্ভব হয় সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংশা বেদান্ত প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায়ের। এই সমস্ত দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি জ্ঞানের প্রামাণ্য হিসেবে বেদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস রূপে স্বীকার করেন। হিন্দু দর্শনের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় যে এই ছয়টি দর্শন সম্প্রদায় বিদ্যমান ছিল খ্রিস্টের জন্মের সময় কাল থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত। হিন্দু দর্শনের প্রত্যেকটি শাখাতেই তাদের সাহিত্য ও জ্ঞানীয় তত্ত্ব বিস্তরভাবে লক্ষ করা যায়। এগুলিকে প্রমাণ বলেও স্বীকার করা হয়। হিন্দু দর্শনের উক্ত ছয়টি শাখা পরস্পর একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায় সমাজে সঠিকভাবে চলার পথকে প্রশস্ত করার জন্য এক একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন—সাংখ্য দার্শনিকগণ—পুরুষ প্রকৃতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপর জোর দিয়েছিলেন। যোগ দার্শনিকগণ—ধ্যান সমাধি ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। নৈয়ায়িকগণ জ্ঞানের উৎসের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বৈশেষিকগণ—রমানুবাদের ব্যাখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর বেদান্তিগণ—বেদের অস্ত ভাগ জ্ঞান কাণ্ডের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। পরবর্তীকালে বেদান্ত দর্শন ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হিন্দু দর্শনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
আম্বেদকর বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি নিজে কখনই একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে চান নি। কারণ বর্ণভিত্তিক হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৯২৭ সালের ২৫ মে ডিসেম্বর ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের হয়ে তথাকথিত উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে দলিত আন্দোলন শুরু করেন। তবে উল্লেক্ষণীয় যে এই আন্দোলনকে তিনি দলিত আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করেননি। এই আন্দোলনকে তিনি সত্যাগ্রহ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন বৃহৎ আকার ধারণ করে। আম্বেদকরের এই আন্দোলনে, তাঁর এই অক্লান্তকর লড়াইয়ে যোগ দেয় সকল বঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষেরা। তাঁর এই আন্দোলনে প্রায় ষাট শতাংশ মানুষই ছিল গ্রামে বসবাসকারী মানুষ। আর এই গ্রামবাসীরা আপন অধিকার ছিনিয়ে নিতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে গ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছিলেন শহরে। তাই বাবা সাহেবের আন্দোলন আরও তীব্রগতিতে এগিয়ে চলতে থাকে। তারা লড়াই করে সমাজের উচ্চ-নীচ এই ভেদ-বিভাজনের বিরুদ্ধে। তারা আন্দোলন করতে থাকে বর্ণ বিভাজন সৃষ্টি করা বেদের বিরুদ্ধে। অত্যাচারী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। আর এই সময় আম্বেদকর হিন্দু ধর্মাবলম্বী না থাকতে চাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃত্ববৃন্দ তাঁর কাছে এসে নিজ নিজ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর পর ১৯৩৬ সালের ১০ জুন লোকনাথ ভিক্ষু আম্বেদকরের সঙ্গে দেখা করেন। এবং বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এর পর আম্বেদকর বৌদ্ধ ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র দলিতদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানান। এমনকী ১৯৪০ সালে আম্বেদকর পালি ভাষায়ও শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি দলিতদের উদ্দেশ্যে অসংখ্য বই লেখেন। এই বইয়ের মূল বক্তব্য ছিল দলিতদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মই একমাত্র মুক্তি এনে দেবে। এই ধরনের পুস্তক প্রকাশের পর ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর নাগপুরে বাবা সাহেব আম্বেদকর আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। আর আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য দলিত তাদের আত্মপরিচয় বজায় রাখার জন্য বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
এত লড়াই এবং কঠোর পরিশ্রমের পর ড. আম্বেদকর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর এই মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির জীবনাবসান ঘটে। শারীরিকভাবে তাঁর জীবনাবসান ঘটলেও তিনি তাঁর কর্মে আজীবন সকলের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। এরই প্রমাণস্বরূপ ১৯৯০ সালে তিনি মরণোত্তর “ভারতরত্ন”, ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। বহু সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ভারতের মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনে আম্বেদকর প্রথম “সমাজচ্যুত ব্যক্তি” হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি কিছু ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দ্বারা বোধিসত্ত্ব সম্মানেও সম্মানিত হয়েছিলেন। যদিও তিনি নিজেকে কখনও বোধিসত্ত্ব হিসেবে দাবি করেননি।